“এই তো দেশ, যেখানে স্বাধীনতা মানে খাতা কলমে লেখা শব্দ, যেখানে গণতন্ত্র মানে মঞ্চে বসা একদল সুবিধাবাদী, আর প্রগতি মানে পেছনে ফেলে যাওয়া মানুষ।”
বাংলা—এই শব্দটি আমাদের জন্ম দিয়েছে, আমাদের ভাষা দিয়েছে, আমাদের পতাকা দিয়েছে; কিন্তু আজ প্রশ্ন জাগে—এই বাংলা কি আমাদের দেশ হয়েছে? না কি, এখনও কেবলই ভূখণ্ড, সীমান্তে বাঁধা এক যন্ত্রণার নাম?
আমরা দেশ পেয়েছি, কিন্তু কীভাবে তা দেশ হয়ে উঠবে—সে প্রশ্ন থেকে গেছে ঝুলে থাকা বিদ্যুৎ লাইনের মতো। আজ বাংলার রাস্তায় দাঁড়ালে, শহরের মোড়ে বসলে, গ্রামে ধানখেতে হেঁটেও মানুষ প্রশ্ন করে—"এই দেশ কি আসলেই আমাদের?" এই প্রশ্ন শুধু ক্ষুধার কারণে নয়, অন্যায়ের কারণে নয়, বরং বারবার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। কারণ এদেশ বারবার নেতৃত্বের মুখোশে প্রতারিত হয়েছে, উন্নয়নের ভেলকিতে সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বাংলাদেশ ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ দেখেছে। বিদ্যমান দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে উঠেছে। যারা ভাষাহীন ছিল, তারা কণ্ঠে সাহস এনেছে; যারা নিঃস্ব ছিল, তারা মাটিতে দাঁড়িয়েছে। মধ্যরাতের অনির্বাচিত শাসন, ভোটের নামে নাটক, দুর্নীতির সর্বোচ্চ সীমা পার করা প্রশাসন আর বিচার বিভাগের দাসত্ব—সব কিছুর বিরুদ্ধে উত্তাল হয়েছে তরুণ প্রজন্ম।
তারা সোচ্চার হয়েছে, তারা রাস্তায় নেমেছে। ব্যারিকেড ভেঙেছে। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় কেবল চোখ নয়, ইতিহাসও ঝাঁঝালো হয়ে উঠেছে। পল্টনে, প্রেসক্লাবে, রাজারবাগে, শহীদ মিনারে মানুষ জড়ো হয়েছে একটিই দাবিতে—এই দেশ আবার মানুষের হোক।
তারা বলেছে—
"দেশ মানে শুধু ভূখণ্ড নয়, দেশ মানে ন্যায়, দেশ মানে প্রতিবাদ করার অধিকার, দেশ মানে গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বর।"
কিন্তু রাষ্ট্র? রাষ্ট্র তখন লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের নাম ধরে গুলি ছুঁড়েছে। ইতিহাসের এই অধ্যায় শুধু ভয়াবহ নয়, রক্তাক্তও। কিন্তু তাতেই জন্ম নিয়েছে প্রশ্ন—বাংলা কবে দেশ হবে?
আজকের বাংলাদেশে প্রয়োজন একজন সাহসী কলমযোদ্ধার, যেমন ছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি। যে রাজনীতিকে নগ্ন করে দেখাতে পারে, যে ক্ষমতার অন্ধকার গলিতে আলো ধরতে পারে, যে মানুষের ভাষা হয়ে উঠতে পারে নির্যাতনের রাতে। গোর্কি বলতেন—"আমি জীবনকে ভালোবাসি, কিন্তু তার রুক্ষ তিক্ততাকে এড়িয়ে যেতে পারি না।" আমরাও আজ সেই তিক্ত সত্যের মুখোমুখি।
বাংলাদেশে আজ প্রয়োজন এমন এক লেখনী, যেটি দলীয় ব্যানারে বন্দি নয়, বরং সাধারণ মানুষের হৃদয় ও যন্ত্রণার দলিল। প্রয়োজন সাহসী চিত্রকরের, যে সাহিত্যে রচনা করবে বাংলার মুক্তির মানচিত্র।
আমাদের সংবিধান আছে, পতাকা আছে, স্বাধীনতার ইতিহাস আছে, ভাষা আন্দোলনের গৌরব আছে। কিন্তু সবই কী শুধুই পাঠ্যবইয়ের পাতায় থাকবে? মানুষ তার নিজের দেশে যদি নিরাপদ না থাকে, ভোট না দিতে পারে, সত্য বলতে না পারে, তাহলে দেশ আসলে কাদের?
একজন কৃষকের জন্য দেশ মানে—তার ফসলের ন্যায্য দাম, একজন তরুণের জন্য দেশ মানে—যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি, একজন সাংবাদিকের জন্য দেশ মানে—সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা, একজন নারীর জন্য দেশ মানে—নিরাপদ পথ। কিন্তু এইসবই আজ কেবল চাওয়া রয়ে গেছে।
তাহলে দেশের শাসক শ্রেণিকে বদলাতে হবে। মানুষকে মানুষের চোখে দেখতে হবে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনগণের সেবায় নিয়োজিত করতে হবে, আর ন্যায়বিচারকে করতে হবে স্বচ্ছ, স্বাধীন ও নির্ভীক।
আমাদের দরকার সেই শিক্ষক, সেই লেখক, সেই সাংবাদিক, সেই রাজনীতিক—যারা মাথা নোয়ান না, বরং সত্য উচ্চারণে সাহসী হন। দরকার এমন শিক্ষা ব্যবস্থা, যেখানে মানুষ তৈরি হয় চাকর খুঁজতে নয়, বরং দেশ গড়তে।
দেশকে দেশ করতে হলে প্রলাপ নয়, প্রজ্ঞা চাই। উন্নয়নের স্লোগান নয়, মানুষকে মানুষ মনে করার দৃষ্টিভঙ্গি চাই। ক্ষমতার চিরস্থায়ীত্ব নয়, জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা চাই। আর চাই সাহসী স্বপ্ন—যেখানে বাংলা শুধু শব্দ থাকবে না, হবে মানুষের জীবন্ত দেশ।
তাই আবার বলি—
বাংলা কবে দেশ হবে?
যেদিন মানুষ রাষ্ট্রের চেয়েও বড় হবে—সেদিনই বাংলা আসলেই দেশ হবে।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com