বিশ্বশক্তির মাঝে এক মহাবীর: ইরান যে বার্তা দিয়ে গেল

inside post
মনোয়ার হোসেন রতন।।
২০২৫ সালের মধ্যভাগে এসে, বিশ্ব যেন একটি অস্থির আগ্নেয়গিরির উপর দাঁড়িয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যকার ১২ দিনের সংঘাত আর দশটা যুদ্ধের মতো ছিল না—এ ছিল এক চেতনার বিস্ফোরণ, এক আদর্শিক অভ্যুত্থান, যা বিশ্বের রাজনীতিকে নাড়া দিয়েছে অন্তর্নিহিত গভীর সত্য দিয়ে। এ যুদ্ধ প্রমাণ করেছে—যেখানে দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে আধিপত্য আর সাম্রাজ্যবাদের দুই রূপ, ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন মহাবীর, যিনি একা নন, বরং সত্য, আত্মত্যাগ ও নৈতিকতার পক্ষের কোটি মানুষের প্রতিচ্ছবি।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট: রণাঙ্গন ও রণচেতনার ফারাক: ইসরায়েলের আগ্রাসন এবং গাজায় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে ইরান সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রতিরোধে নামে। হিজবুল্লাহ, হুথি, হামাস এবং হাশদ আশ-শাবির মতো সংগঠনসমূহ একসাথে একটি প্রতিরোধ ফ্রন্ট গঠন করে, যা শুধু সামরিক নয়, আদর্শিক জোট হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করে। ইরানের এ নেতৃত্ব পশ্চিমা বিশ্বকে বার্তা দেয়—‘প্রতিরোধ কখনো একা হয় না, প্রতিরোধ কখনো মরে না’।
রাজনৈতিক বার্তা: শক্তির সংজ্ঞা পুনর্লিখন:
এ যুদ্ধে স্পষ্ট হয়েছে—বিশ্বশক্তির ধারণা একপাক্ষিক নয়। ইরান একটি নিষেধাজ্ঞা-বিধ্বস্ত রাষ্ট্র হয়েও দেখিয়ে দিয়েছে—কীভাবে আত্মমর্যাদা, বিশ্বাস, এবং চেতনা দিয়ে ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান আর ড্রোনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যেখানে আধিপত্যের নতুন মানচিত্র আঁকতে চেয়েছে, সেখানে ইরান সেই মানচিত্রে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের মতো নেতারা যখন চুক্তির নামে ষড়যন্ত্র, আর স্বাধীনতার নামে দখলদারিত্বকে বৈধতা দিতে চেয়েছেন, তখন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এক হাত তুলে বিশ্বকে বলেছিলেন—“আমরা মরে যাব, কিন্তু মাথা নত করব না।” এ বার্তা রাজনৈতিক বিশ্ববোধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সামরিক বার্তা: প্রযুক্তির ঊর্ধ্বে আদর্শ:
ইসরায়েলের উন্নততম আয়রন ডোম ও মার্কিন গোয়েন্দা সহযোগিতা সত্ত্বেও ইরান-সমর্থিত ফোর্সগুলো একাধিকবার তাদের ভেতরে আঘাত হেনেছে। সাইবার হামলা, ড্রোন স্ট্রাইক, এবং লক্ষ্যভেদী ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগ—এ সবকিছু প্রমাণ করে ইরান শুধু নৈতিকতায় নয়, সামরিক কৌশলেও আধুনিক ও সজাগ।
কিন্তু এ যুদ্ধের আসল শিক্ষা ছিল—আত্মা দিয়ে চালিত একটি জাতি কখনো প্রযুক্তির কাছে হার মানে না।
নৈতিক বার্তা: নিঃসঙ্গতা নয়, দৃঢ়তা:
ইরান যখন ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ায়, তখন অধিকাংশ আরব রাষ্ট্র মৌন। তারা স্বার্থ আর সম্পর্কের বন্ধনে বাঁধা। কিন্তু ইরান একা থেকে বিশ্বকে শিখিয়ে দেয়—“সত্য একা হলেও কখনো দুর্বল নয়।”
এ বার্তা বিশেষভাবে গর্জে ওঠে আল-কুদসের পথে, যেখানে প্রতিটি রক্তাক্ত পাথর আজ সাক্ষী হয়ে বলছে: “আমরা পরাজিত হইনি, বরং জেগে উঠেছি।”
ভবিষ্যতের বাস্তবতা: নতুন জোট, নতুন ন্যারেটিভ: এ যুদ্ধ ইঙ্গিত দিয়েছে—পশ্চিম কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প তৈরির সময় এসে গেছে। ইরান, রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, কাতারসহ একাধিক রাষ্ট্র ধীরে ধীরে একটি নৈতিক, মানবিক ও প্রতিরোধ কেন্দ্রিক জোটের দিকে এগিয়ে চলেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের আধিপত্যবাদী কৌশল ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ইতিহাসের মঞ্চে একাকী নায়ক: ছবিতে তিনজন মানুষ—একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী ট্রাম্প, অন্যদিকে ইসরায়েলের নেতানিয়াহু। মাঝখানে আছেন ইরানের আয়াতুল্লাহ খামেনি—এক মহাবীর, যিনি কেবল একজন নেতা নন, বরং একজন আদর্শের প্রতিমূর্তি। তাঁর হাতে উঠে আসা একটি হাত—বিশ্বকে বলছে, “আমি আছি, কারণ সত্য আজো বেঁচে আছে।”
এ যুদ্ধ থেমে গেলেও বার্তাটি বেঁচে থাকবে। কারণ ইতিহাস বলে, একদিন সেই কথাই জয়ী হয়—যা রক্তে লেখা হয়, প্রতিরোধে রচিত হয়, আর চেতনায় বাঁচে।
স্মরণ রাখতে হবে,যে জাতি শুধু অস্ত্র দিয়ে নয়, বিশ্বাস, চেতনা এবং আত্মত্যাগ দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে—তাদের কাছে পরাজয় কেবল একটি ক্ষণিক থেমে যাওয়া, চিরন্তন নয়।
আরো পড়ুন