মনোয়ার হোসেন রতন।।
“আমাদের চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। খাবার দেওয়া হতো না ঠিকমতো। ঘুমাতে দেওয়া হয়নি একটিবারের জন্য। আমরা জানতাম না, বেঁচে ফিরবো কি না।”
এভাবেই পাঁচদিন পর মুক্ত হয়ে ফিরে এসে বলছিলেন একজন মানবাধিকার কর্মী—যিনি ছিলেন একটি আন্তর্জাতিক শান্তি মিশনের অংশ। মিশনটি যাচ্ছিল গাজায়, যেখানে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। কিন্তু সেই মিশনের পরিণতি হলো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নির্মম অপহরণ।
এই ঘটনা শুধু একটি হামলা নয়। এটি মানবতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ। এটি বিশ্ব বিবেককে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো এক লজ্জাজনক কলঙ্ক।
একটি শান্তির যাত্রা, কিন্তু গন্তব্য বন্দিত্ব
যারা এই যাত্রায় ছিলেন, তারা কেউ সৈনিক নন, কেউ রাজনীতিক নন—তারা চিকিৎসক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, শান্তিকামী সাধারণ মানুষ। তারা কেউই কোনো দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেয়নি। তাদের সঙ্গে ছিল চিকিৎসা সরঞ্জাম, খাবার, শিশুদের জন্য খেলনা। উদ্দেশ্য ছিল শুধুই একটিই—অবরুদ্ধ গাজার জনগণের পাশে দাঁড়ানো।
কিন্তু আন্তর্জাতিক জলসীমায়, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে, ইসরায়েলি সেনারা সশস্ত্র হামলা চালিয়ে পুরো কাফেলাকে জোরপূর্বক জিম্মি করে নিয়ে যায়।
যেখানে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে অমানবিক নির্যাতন আর অনিশ্চয়তার মধ্যে।
এটি কি আধুনিক সভ্যতার নমুনা? এটি কি সেই ‘গণতান্ত্রিক’ ইসরায়েল, যার প্রতি পাশ্চাত্যের অন্ধ সমর্থন?
নির্যাতনের বিবরণে কেঁপে উঠেছে বিশ্ব বিবেক
পাঁচদিন পর যারা মুক্তি পেলেন, তারা ফিরে এসে যে বিবরণ দিয়েছেন, তা যেন মধ্যযুগীয় নির্যাতনের আধুনিক সংস্করণ।
“আমাদের দিনের পর দিন অন্ধকার ঘরে রাখা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে অপমান করা হয়েছে। খাবার দেওয়া হতো না ঠিকমতো। চিৎকার করে জানতে চাওয়া হতো—‘তোমরা কেন গাজায় যাচ্ছ?’”
এই প্রশ্নই যেন আজকের সভ্যতার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
গাজায় যাওয়ার অপরাধে একজন মানুষ কীভাবে বন্দি হয়? মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে চাওয়ার অপরাধে কেউ কীভাবে হয় শত্রু?
বিশ্বের নীরবতা: এক লজ্জাজনক নৈঃশব্দ্য
এই ঘটনায় সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক দিকটি হলো বিশ্বনেতাদের নিরবতা।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র—কারও কাছ থেকে দেখা যায়নি তীব্র কোনো প্রতিবাদ, কোনো কার্যকর নিন্দা, কিংবা জবাবদিহির আহ্বান।
বিশ্বব্যবস্থা কি এখন আর ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের উপর দাঁড়িয়ে নেই?
নাকি এটি এখন সম্পূর্ণরূপে অর্থ, অস্ত্র ও রাজনীতির রক্তচক্ষুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে?
যেখানে একটি দেশ স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে, সেখানে শুধু বিবৃতি নয়, জবাবদিহি এবং শাস্তি হওয়া প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু তার পরিবর্তে দেখা গেল, কূটনৈতিক ছলনার চাদরে ঢেকে রাখা হলো এই বর্বরতা।
ইসরায়েলি আগ্রাসনের ইতিহাস: একটি ধারাবাহিক অপরাধচিত্র
এই প্রথম নয়। ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছে।
গাজা, পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুজালেম—সবখানেই প্রতিনিয়ত চলছে বসতি নির্মাণ, জনগণকে উচ্ছেদ, চিকিৎসা ও খাদ্য সরবরাহে বাধা, সাংবাদিক হত্যা, এমনকি হাসপাতালেও হামলা।
কিন্তু কী আশ্চর্য! পৃথিবীর তথাকথিত মানবাধিকার রক্ষাকারী রাষ্ট্রগুলো এর বিরুদ্ধে যেন নির্বাক।
কোথাও নেই কার্যকর অবরোধ, কোথাও নেই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ডাক, নেই কোনো নিষেধাজ্ঞা। বরং দেখা যায়, অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সমর্থন অব্যাহত।
নেতার লজ্জা, জনতার রক্তক্ষরণ
বিশ্বের নেতৃত্ব আজ যে নৈতিক দেউলিয়াপনায় ভুগছে, এই ঘটনা তার নগ্ন প্রমাণ। যে জাতিসংঘ ‘মানবাধিকারের রক্ষাকবচ’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল, আজ তার ভূমিকা শুধুই কিছু গড়গড়ে বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ।
আর যারা নিজেদের গণতন্ত্রের পতাকা বাহক বলে দাবি করে, তারা আজ অবিচারের শরিক।
বিশ্বনেতাদের এই নিরবতা একপ্রকার সম্মতির নামান্তর।
যদি আপনার প্রতিবাদ না থাকে, তবে আপনার চুপ থাকাই আগ্রাসনের পক্ষে অবস্থান।
একটি প্রশ্ন, যা আজ ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে
আজ আমাদের প্রত্যেককে প্রশ্ন করতে হবে—“আমরা কোন পৃথিবীতে বাস করছি? যেখানে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে চাওয়াই অপরাধ? যেখানে নিরস্ত্র মানুষের শান্তিকামী যাত্রা দমন করা হয় অস্ত্রের মুখে?”
এই পৃথিবী কি সত্যিই ‘সভ্য’?
নাকি আমরা ঢেকে রেখেছি আমাদের অমানবিকতার মুখোশ এক কল্পিত মানবতাবাদের পেছনে?
আমাদের করণীয়: চুপ থাকলে চলবে না
এই ঘটনার পর আর নিরপেক্ষ থাকা যায় না। নিরপেক্ষতা এখন অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর নাম। চুপ থাকা মানে হামলাকারীর হাত শক্ত করা। প্রতিটি বিবেকবান মানুষ, রাষ্ট্র এবং সংগঠনের এখন দায়িত্ব—জোরালো প্রতিবাদ জানানো, আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করা, ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া।ইতিহাস ক্ষমা করবে না। মানবতা এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে ক্ষমতাবানের নির্মম নিষ্ঠুরতা, অন্যদিকে কিছু সাহসী মানুষের শান্তির মিছিল।
আমরা কাদের পাশে দাঁড়াবো?
যদি আমরা চুপ থাকি, তাহলে এই অপরাধ শুধু ইসরায়েলের থাকবে না—
এই লজ্জার অংশীদার হবো আমরাও।
“বিশ্ব নেতারা, এখনও সময় আছে—জেগে উঠুন। মানবতার কফিনে শেষ পেরেকটা আপনাদের হাতে যেন না ঠুকে যায়।”
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com