।। মোতাহার হোসেন মাহবুব।।
কাজী মোমিনুল হক ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার কাহেতরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম : কাজী কোরবান আলী। মাতার নাম : ছায়েদা খাতুন। ৫ ভাই ১ বোনের মধ্যে কাজী মোমিনুল হক সবার ছোট ভাই। তিনি ১৯৭৭ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) পাস করেন।
কুমিল্লা জেলা বিএনপি-র সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী মোমিনুল হক ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কুমিল্লা জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন।
জীবৎকালে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি কথা শুরু করেন এভাবে :
১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল তিনি ভারতের সোনামুড়া যান। ওখানে ফকির বাড়িতে কুমিল্লা, ঢাকা ও ফরিদপুরের প্রায় এক শ’ জন ছাত্র একত্রিত হয়ে ওইদিন বিকেলে তৎকালীন এমএনএ অধ্যাপক খোরশেদ আলম ও ক্যাপ্টেন হায়দারের সাথে দেখা করে। ক্যাপ্টেন হায়দার তখন ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে কে পারবে পাঞ্জাবীদের ব্যাংকার থেকে ধরে আনতে? কাজী মোমিনুল হক ক্যাপ্টেন হায়দারের এ প্রশ্ন প্রসঙ্গে বলেন, ‘হায়দার সাহেব মূলত ছাত্রদের সাহস যাচাই করতেই এ প্রশ্ন করেছিলেন।’ ক্যাপ্টেন হায়দারের এ প্রশ্নের উত্তরে সায় দিয়ে কাজী মোমিনুল হকসহ ২৫ জন ছাত্র হাত তোলেন। এ-২৫ জনকে ২নং সেক্টরের প্রথম হেডকোয়ার্টার মতিনগর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার, লেফটেন্যান্ট দিদার ও হাবিলদার মনির। প্রশিক্ষণ শেষে মতিনগর থেকে মে মাসে মেলাঘরে যান প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২৫ জন। এ সময় ২৫ জনসহ প্রায় পাঁচ শ’ মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন মতিনগরে বোমা মারতে শুরু করে তখন এ-ক্যাম্পটি মেলাঘরে স্থানান্তরিত করা হয়। ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ মেজর খালেদ মোর্শারফ এ-ক্যাম্পেই অবস্থান করেন। মেলাঘর থেকে কাজী মোমিনুল হকসহ ২৫ জনকে সালদা নদী এলাকায় মে মাসের শেষের দিকে বদলী করা হয়। তাঁকে মাইন প্লাটুন কমা-ার পদে বদলী করা হয়। কোতয়ালী-বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া থানা নিয়ে এ সাব সেক্টরের কমা-ের দায়িত্ব পালন করেন মেজর সালেক ও ক্যাপ্টেন গাফফার। এ সাব সেক্টরে যুদ্ধ করেন মুক্তিযোদ্ধা কাজী মোমিনুল হকসহ ২৫ জন সহযোদ্ধা।
এ যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্রাহ্মণপাড়া থানার বড়দুশিয়া গ্রামে, আমাদের পোতা মাইন ফিল্ডে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন আমানগুলসহ ২০ জন সৈন্য মারা যায়। এছাড়া রাজাপুরের হরিমঙ্গল রেলওয়ে ব্রীজ, সেনের বাজার ব্রিজ, মান্নরা ব্রিজ ও কসবা থানার বিজনা নদীর ব্রিজ আমরা মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিই। এতে হানাদার বাহিনীর সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মেজর খালেদ মোর্শারফের নির্দেশে জিবনা নদীর ব্রিজ উড়িয়ে দিই ও ব্রিজের পাশে হানাদার বাহিনীর ব্যাংকারে দুটি আক্রমণ করি। আমরা তখন জমির বদলী শ্রমিকের বেশে ঘাস কাটার ঝুঁড়িতে এন্টি ট্যাংক মাইন নিয়ে ব্যাংকারের কাছাকাছি যাই এবং গেরিলা কায়দায় শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমরা ১০ জনের দলের প্রথমে আর্মিসহ ৪ জন কৃষকের বেশে গেরিলা কায়দায় ব্রিজের দুপাড়ে দুটি ব্যাংকারে এন্টি ট্যাংক মাইন প্রবেশ করিয়ে মাইন করডেস ও সেপটি ফিউজ সংযুক্ত করে সেপটির ম্যাচের মাধ্যমে আগুন দেয়ার দুমিনিটের মধ্যে রেললাইন ব্রীজসহ ব্যাংকার উড়ে যায়। সময়টা তখন ছিল জুলাই মাসের কোন এক দুপুর বেলা। পাকিস্তানী আর্মিরা তখন ব্যাংকারে ঘুমুচ্ছিল্ শত্রুদের পরাজিত করে আমরা বিজনা নদীর পাড়ে বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করি। এ-অপারেশনের সময় চাঙ্গিনীর সুবেদার নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে এক প্লাটুন বাঙালি সৈন্য দুদিক থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে আমাদের ঘিরে রেখেছিল। উপর থেকে নির্দেশ ছিল, যদি আমরা পাঞ্জাবীদের হাতে ধরা পড়ি তবে আমাদের গুলি করে মেরে ফেলার। অপারেশন সফল হওয়ার পর মেজর খালেদ মোর্শারফ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। তখন তাঁর সাথে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ছিল। তিনি আমার নেতৃত্বাধীন প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকে ধন্যবাদ জানান এবং দু’হাজার টাকা পুরস্কার হিসেবে প্রদান করেন।’
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের একদিন ৪টার দিকে মেজর সালেকের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা শশীদল ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ২০ জন শহিদ হয়। শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের কুল্লাপাথর এলাকায় দাফন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা কাজী মোমিনুল হকসহ তার নেতৃত্বধীন মুক্তিযোদ্ধারা এ দাফন কাজে অংশগ্রহণ করেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর ফকিরহাট স্টেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের পোতা মাইনে ৪-৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য মারা যায়।
সেপ্টেম্বর মাসে কাজী মোমিনুল হকসহ ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার ব্যাচ থেকে বাছাই করে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিলুনিয়া বর্ডারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে কমান্ডিং অফিসার মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে তারা ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অক্টোবর মাসে বিলুনিয়া সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা নিলক্ষী গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। ওই আক্রমণে হানাদার বাহিনীর ৫-৬ জন সৈন্য মারা যায়, বাকি সৈন্যরা পালিয়ে যায়। হানাদারমুক্ত হয় ওই অঞ্চল।
নভেম্বরের শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি ফেনীতে অবস্থান নেয়। ফেনীতে আসার পথে বিভিন্ন স্থানে খ- খ- যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যসহ রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর অনেক লোককে মুক্তিযোদ্ধার এ দলটি মেরে ফেলে। নভেম্বর মাসের মধ্যে ফেণী হানাদার মুক্ত হয়। মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটি শত্রুদের পরাস্ত করে ক্রমে ফেনী থেকে চৌমুহনী ও মাইজদী কোর্টের দিকে এগিয়ে যায় এবং এ এলাকা হানাদার মুক্ত করে।
১ ডিসেম্বর ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ মুক্তিযোদ্ধারা সড়ক পথে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এ মাসের ১৪ তারিখ বার আউলিয়া মাজারের সামনে পরাজিত পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। ওইদিন রাতে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান নেয়। ওখান থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিবাহিনীর এ-দলটি স্বাধীনতা বিরোধিদের সাথে খ- খ- যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর সারা দেশের মতো চট্টগ্রামও হানাদারমুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি ঘিরে আলাপচারিতার শেষ পর্যাযে মুক্তিযোদ্ধা কাজী মোমিনুল হক বলেন, ‘যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, সেই উদ্দেশ্য আজও বাস্তবায়িত হয় নি। অর্থনৈতিক মুক্তি আজও অর্জিত হয় নি। একটু থেমে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী মোমিনুল হক সেদিন বলেছিলেন, ‘দেশপ্রেমী মুক্তিযোদ্ধারা যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে, তবেই দেশের উন্নয়ন হবে।’ তাঁর এ আশা অপূর্ণই থেকে গেল। গত ৫ এপ্রিল তিনি কুমিল্লা মহানগরের ঝাউতলায় একটি ভাড়া বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুসংবাদ জানান আমার প্রতিবেশী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মমিন। বিশ্বাস হয় নি। স্বাধীনতা দিবসে তথা ২৬ মার্চ মোমিন ভাই, আমি ও জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট উন্নত খাবার পরিবেশন পরির্দশন টিমের সদস্য হিসেবে কুমিল্লা সদর হাসপাতাল ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করি। তাঁর স্বভাবসুলভ ভ্রাতৃত্ববোধ ভোলা যায় না। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com