বুলেটে মুছে গেছে সাব্বিরের যত রঙিন স্বপ্ন
মমিনুল ইসলাম মোল্লা, মুরাদনগর।।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের ডেকরিপাড় গ্রাম। গ্রামের অতি-দরিদ্র পরিবারে জন্ম সাব্বিরের। দারিদ্রতার কষাঘাতে কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন। পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান সাব্বির। স্বপ্ন ছিল বৈষম্য দূরকরণ ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার। এই ভাবনায় গত ৪ আগস্ট কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঁশকাইট কলেজ থেকে বন্ধুদের সাথে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন। সেই দিন দেশব্যাপী ছিল চরম উত্তেজনা। ছাত্রদের দাবি তখন ‘এক দফা’। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পদত্যাগ। অন্যদিকে আওয়ামী তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে অস্ত্রসজ্জিত অবস্থান রাজপথে।
এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ছাত্র-জনতার সাথে সকাল থেকে আন্দোলনে নেমে পড়েন সাব্বির। পাহাড়পুর ইউনিয়নের বাঁশকাইট কলেজের সামনে আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী ও পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পিছু হটে ছাত্র-জানতা। পরবর্তীতে অবস্থান নেন ইলিয়টগঞ্জ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। তখন দুপুর ঘনিয়ে বিকেল। রাজপথে সরকার পদত্যাগের উত্তাল মিছিল। হঠাৎ মিছিলে বাধা সৃষ্টি করেন আওয়ামী কর্মীরা, সাথে পুলিশ। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। ছাত্র-জনতার ইট পাটকেলের জবাবে পুলিশ চড়াও হয়ে নির্বিচারে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে পুলিশের রাবার বুলেট সাব্বিরের বাম চোখে লাগে। আরেক সহযোদ্ধা রাসেল মিয়া সাব্বিরকে অচেতন অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে চিকিৎসকরা তাকে ফিরিয়ে দেন। চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যান বেসরকারি ইস্টার্ন মেডিকেল হাসপাতালে। চোখে গুলি আছে শনাক্ত করে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা প্রেরণ করেন। সেখান থেকে ঢাকা জাতীয় চোখ বিজ্ঞান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। ওখানে সাব্বিরের অপারেশন হয়। দ্বিতীয় অপারেশন করা হয়েছে ঢাকা ইসলামিয়া হাসপাতালে।
বুলেটের আঘাতে সাব্বিরের জীবনের রঙিন স্বপ্নগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কালো গ্লাসের আবরণে ঢাকা তার দু’চোখ। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। কি যেন বলতে চান। বলতে পারেন না। প্রতিবেদক জানতে চায় সাব্বিরের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা! সে বলেন, ‘কি আর বলব! আমি অটোরিকশা চালক ক্যান্সার আক্রান্ত পিতার বড় সন্তান। বাবার স্বপ্ন ছিল আমিই সংসারের হাল ধরব। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে আমি বড়। খুবই গরিব আমরা। তিন বেলা খেতে কষ্ট হয়। তাই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে আর স্কুলে যাইনি। বাবা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকেন। তিনি ব্লাড ক্যান্সারে রোগাক্রান্ত। ছোট ভাই বোনদের কথা চিন্তা করে লেখাপড়া ছেড়ে পাঁচপুকুরিয়া বাজারে মায়ের দোয়া বিপণী বিতানে কর্মচারী হিসেবে কাজ নিই। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। যখনই দেশে আন্দোলন শুরু হয় তখন থেকে মনটা ওখানে পড়ে থাকে। ছেলেদের সাথে নৈতিক দাবি আদায়ের মিছিলে যেতে মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। সাব্বির আরো বলেন, গত ৪ আগস্ট দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ি। সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ দিই। প্রথমে বাঁশকাইট কলেজে যাই সেখানে পরিস্থিতি খারাপ ছিল। উপজেলা চেয়ারম্যান কিশোর আলম সন্ত্রাসী নিয়ে দৌড়ানি দেয়। পরে ইলিয়টগঞ্জ গিয়ে রাজপথে অবস্থান করি। ওখানে সরকার পতনের মিছিল চলাবস্থায় পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বেরিকেটের মধ্যে পড়ি। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ লোকজন আমাদের মারতে থাকে। তুমুল সংঘর্ষের মধ্যে এক পর্যায়ে চোখে কিছু একটা পড়ছে মনে হলো। তারপর আর কিছু বলতে পারব না। জ্ঞান ফিরতে দেখি আমি হাসপাতালে। দু’চোখে কালো চশমা। এক চোখে কিছু আবছা দেখা যায়, আরেক চোখ বন্ধ। পৃথিবী অন্ধকার। মনটা খুব খারাপ লাগছিল। আর বুঝি দু’চোখ মেলিয়া সুন্দর পৃথিবী দেখা হবেনা। দেখা হবে না প্রিয় মানুষগুলো। কেউ আর আমায় ভালোও বাসবেনা। যখন মনের মধ্যে কষ্টগুলো জল্পনা-কল্পনায় ভাসছিল তখনই পেলাম মহাখুশির সংবাদ হাসিনা সরকারের পতন হইছে।
বর্তমানে শারিরীক অবস্থা কেমন এমন প্রশ্নে সাব্বিার জানান, আলহামদুলিল্লাহ চিকিৎসা চলছে। ঘাতক পুলিশের আঘাতে চোখের দুটি পর্দা ছিড়ে গেছে। আমার চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছি। তারা রীতিমত খোঁজ-খবর রাখছেন। মাথায় একটি বুলেট রয়ে গেছে। তাই মাথা প্রচন্ড ব্যথা করে। ওটা বের করতে ডাক্তার বলেছেন, অনেক বড় একটা অপারেশন করা লাগবে। চিকিৎসকরা কোনো ফি নিচ্ছেনা। চিকিৎসা ফ্রি করে দিয়েছে। এক মাস পর পর চিকিৎসার জন্য ঢাকা যেতে হয়। কিন্তু গাড়ি ভাড়া দিয়ে যাওয়ার পয়সা থাকেনা।
সাব্বিরের বাবা রনি মিয়া বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে আমার ছেলেকে ফার্মগেইট ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার চোখের অপারেশন করিয়েছেন। কিন্তু গুলি লাগা চোখ দিয়ে দেখতে পারে না সাব্বির। ছেলেটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন আমার কেড়ে নিলো আওয়ামী পুলিশ। ছেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। মুরাদনগর উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুর রহমান উজ্জল ও নাহিদুল ইসলাম নাঈম জানান, সাব্বির আমাদের জীবন্ত শহীদ। ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশ শান্তিপূর্ণ এক দফা আন্দোলনের মিছিলে গুলি করে সাব্বিরের সুন্দর জীবনটাকে অন্ধকার করে দিয়েছে। আমরা এই ভাইটির পাশে আছি। তাঁর পরিবারের সার্বিক খোঁজ-খবর নিচ্ছি।