ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লইসকা বিলে নৌকাডুবি : মাঝি এখনো আড়ালে!

এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লইসকা বিলে দুই বাল্কহেডের ধাক্কায় যাত্রীবাহী নৌকাডুবির ঘটনায় ‘সোনা মাঝি’ এখনও সব কিছুরই আড়ালে ! ভয়াবহ এই নৌকাডুবিতে ২৩ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় পাঁচজন গ্রেপ্তার, সাতজনের বিরুদ্ধে রজুকৃত মামলা, এসবের কিছুতেই সম্পুক্ত হয়নি সোনা মাঝি ও সংশ্লিষ্টদের নাম। যদিও বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা দুষছেন তাদেরকেই। এদিক তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নিমিত্তে গঠিত তদন্ত কমিটি পাঁচ দিনেও প্রতিবেদন দিতে সক্ষম হননি, চালিয়ে যাচ্ছেন তদন্ত কাজ।
২৭ আগস্ট শুক্রবার বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লইসকা বিলে ডুবে যাওয়া নৌকার চালক, সহযোগীদের পদে পদে দায় থাকলেও তারা এখনো পর্যন্ত আছেন নিরাপদেই। এ ঘটনায় রজুকৃত মামলাও নেই তাদের নাম। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই এবং সরু খালে ওভারটেক করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর থেকে সকল মহল যাত্রীবাহী নৌকার চালক ও তার সহযোগীদের এ জন্য দায়ী করে আসছেন। এদিকে পাঁচ দিনের মাথায় দুর্ঘটনা কবলিত নৌকার মাঝি ও বেঁচে যাওয়া যাত্রীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ৩০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে কমিটির সদস্যরা। তবে প্রাথমিক তদন্তে দুর্ঘটনাকবলিত নৌকার মাঝিকেই দুষছেন বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা। তদন্ত কমিটির কাছে এ সংক্রান্ত বিষয়ে একাধিক যাত্রী সাক্ষ্য দিয়েছেন।ঘটনার পর শুক্রবার রাতেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গঠন করা হয় তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডএম) মো. রুহুল আমিনের নেতৃত্বে কমিটির অপর সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোজাম্মেল হোসেন রেজা ও ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম। তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনার স্থলে পাঁচ দিনেও প্রতিবেদন দাখিলে সমর্থ হননি। তবে তদন্তে দুর্ঘটনার একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন। সব বিষয়ে তদন্ত করে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে কমিটি নিশ্চিত করেছেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং ওই নৌকার যাত্রীরা নৌকাডুবির জন্য চালক-সহযোগীদেরকে দায়ী করেন। তদন্ত কমিটির কাছেও তাদের দায়ী করে সাক্ষ্য দেন স্থানীয়রা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারাও নৌকাডুবির কারণ সম্পর্কে যাত্রীবাহী নৌকাটি ওভার লোডের কথা বলেন। চালকের অনভিজ্ঞতা দায়ী করে বলেন, প্রথমে খালি একটি বাল্কহেডকে পেছন থেকে ওভারটেক করতে গিয়ে যাত্রীবাহী নৌকাটি ধাক্কা খায়। এরপরই যাত্রীরা চালককে খালের বাম দিকে অর্থাৎ রাস্তার পাশে সরে যেতে বললেও সে বাম দিকে সরে না গিয়ে সামনের দিক থেকে আসা অপর একটি বালু বোঝাই বাল্ক হেডের ওপর উঠিয়ে দেয়। এরপর মুহূর্তেই নৌকাটি ডুবে যায়। তাছাড়া নৌকাটিতে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী থাকায় খালি বাল্কহেডকে ধাক্কা দিয়ে টাল সামলাতে ব্যর্থ হয় চালক। কিন্তু এ ঘটনায় যে মামলা হয়েছে সেখানে নাম নেই যাত্রীবাহী নৌকার চালক-সহযোগী কারোরই। নৌকাটির চালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের চতরপুরের সোনা মিয়া, তার দুই সহযোগী আদমপুর গ্রামের দানু মিয়া এবং ফতেহপুরের সোলায়মান। শুধু তাই নয়, মামলার এজাহারেও ঘটনার উল্টো বিবরণ দেয়া হয়েছে। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রী জামাল মিয়া জানান, তার বাড়ি হবিগঞ্জে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কান্দিপাড়ায় বসবাস করেন। ঘটনার দিন বিজয়নগরের মুকুন্দপুর গ্রামে ব্যবসায়িক কাজ শেষে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে চম্পকনগর ঘাট থেকে নৌকায় ওঠেন।  তিনি নৌকার উপরের অংশে ছিলেন। দূর থেকে দুটি বড় আঁকারের নৌকা (বাল্কহেড) আসতে দেখে নৌকার মাঝিকে ডান পাশ দিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু মাঝি সেটি আমলে না নিয়ে তাদেরকে চুপ থাকার পরামর্শ দিয়ে বাম পাশ দিয়েই যায়। নৌকাটিতে যাত্রী ধারণের ঠাঁই ছিল না। মাঝির ভুলের কারণেই এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে দুর্ঘটনার পর থেকে নৌকার মাঝি হিসেবে পরিচিত ‘সোনা মাঝি’ পলাতক রয়েছেন। মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোজাম্মেল রেজা জানান, নৌকাডুবির ঘটনায় ২৮ আগস্ট দুই বাল্কহেডের মালিক, চালক ও তার সহযোগীসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাটি দায়ের করেন নৌ দুর্ঘটনায় একই পরিবারের চারজন নিহত পরিবারের সদস্য বিজয়নগর চম্পকনগর ইউনিয়নের গেরাগাঁও গ্রামের মো. সেলিম মিয়া। মামলায় এমভি ‘ইয়া রাসূল আল্লাহ’ বাল্কহেডের চালক ও সহযোগী তিনজন জমির মিয়া, মো. রাসেল, খোকন মিয়া এবং মালিক মো. সোলায়মানকে আসামি করেন। এছাড়া অপর বাল্কহেড এমভি রউফ শাহী নৌযানের মালিক মোস্তফা মিয়া ওরফে মোস্তফা মেম্বার এবং চম্পকনগর নৌকাঘাট পরিচালনাকারী দুই সদস্য সোলাইমান মিয়া ও মিস্টু মিয়াকেও আসামি করা হয়েছে। তবে ডুবে যাওয়া ট্রলারের মাঝি সোনা মিয়া ও তার দুই সহযোগীকে এই মামলায় আসামি করা হয়নি। দুর্ঘটনার পঞ্চম দিন অতিবাহিত হয়েছে। এ পর্যন্ত বেঁচে যাওয়া যাত্রীসহ ৩০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি। সব সাক্ষীর তথ্য-উপাত্ত মিলিয়েই প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করা হবে। একাধিক কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘একাধিক বিষয়ের ওপর তদন্ত করছি। বেঁচে যাওয়া যাত্রী ছাড়াও চম্পকনগর ঘাটের একাধিক সাক্ষীর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এর মধ্যে একজন মুড়িওয়ালা (নাম প্রকাশ করেনি তদন্তের স্বার্থে) আমাদেরকে জানিয়েছেন যাত্রীবাহী নৌকাটি সাড়ে চারটায় চম্পকনগর ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও নৌকাটি ৪টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে যায়। নৌকাটির ছিলো না কোনো ফিটনেস, এমনকি লাইফ সাপোর্টও। চালকের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ না থাকায় অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিলো। এসব কারণকে সামনে রেখেই তদন্ত করা হচ্ছে। একাধিক কারণ পাওয়া গেছে। এই মুহূর্তে কেবলমাত্র একটি কারণ চিহ্নিত করে দুর্ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী করা যাচ্ছে না। একাধিক কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। সব বিষয়ে তদন্ত করে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ চিহ্নিতকরণ, কারণ উল্লেখে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।’
উল্লেখ্য, গত ২৭ আগস্ট শুক্রবার বিকেল ছ’টার দিকে যাত্রীবাহী নৌকাটি জেলা শহরের অনতিদূরের বিজয়নগরের পত্তন ইউনিয়ন এলাকার তিতাস নদী সংলগ্ন লইসকা বিলে ডুবে যায়। এসময় ৫০ জনের মতো যাত্রী সাঁতরে তীরে ওঠতে সক্ষম হলেও প্রাণ হারান ২৩ জন। আহত অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন অন্তত ১৫ জন।