ঢাকার ছাত্র রাজনীতির স্রোত পরিবর্তন:
মনোয়ার হোসেন রতন ।।
সম্প্রতি ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ড. শশী থারুর বাংলাদেশের এক অভ্যন্তরীণ ছাত্র রাজনৈতিক ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যা আলোড়ন তুলেছে উভয় দেশের রাজনৈতিক মহলে। তাঁর মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এ জামায়াতে ইসলামী-র ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির-এর অভাবনীয় বিজয় একদিকে বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক মেরুকরণের ইঙ্গিতবাহী, অন্যদিকে ভারতের জন্য এক প্রকার সতর্ক সংকেত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: একটি জাতির রাজনৈতিক ব্যারোমিটার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক একটি যুগান্তকারী রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্মভূমি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কিংবা গণঅভ্যুত্থান—প্রতিটি পর্যায়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নেতৃত্বের কেন্দ্রে।
এই প্রতিষ্ঠান যখন কোন ভিন্ন রাজনৈতিক ধারার দিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন সেটি নিছক ছাত্র রাজনীতির পরিবর্তন নয়, বরং একটি জাতির রাজনৈতিক মনোভঙ্গির প্রতিফলন হয়ে ওঠে। শশী থারুর সঠিকভাবেই একে "রাজনৈতিক টেকটোনিক প্লেটের স্থানান্তর" বলেছেন।
শিবিরের বিজয়: পরিবর্তনের বার্তা না মৌলবাদের উত্থান? থারুর তাঁর মন্তব্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন, এই বিজয় সরাসরি ইসলামী মৌলবাদের উত্থান বোঝায় না। বরং এটি প্রথাগত রাজনীতির প্রতি জনগণের এক ধরনের অসন্তোষ ও বিকল্পের আকাঙ্ক্ষা। তিনি বলেন:
“এটি শিবিরের আদর্শের প্রতি অন্ধ আনুগত্য নয়, বরং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দীর্ঘমেয়াদী ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির প্রতি জনগণের অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ।”
– সূত্র: Business Today, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
তিনি আরও বলেন, নতুন প্রজন্মের অনেকেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের বিতর্কিত ভূমিকা প্রত্যক্ষ করেননি। তাঁদের কাছে শিবির আজকের একটি রাজনৈতিক বিকল্প, যাদের গায়ে এখনও দুর্নীতির ছাপ পড়েনি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ভারতের দৃষ্টিকোণ: ড. থারুরের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বেশ নাজুক। দীর্ঘদিন ভারতের আস্থা ভাজন হিসেবে বিবেচিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বহীন অবস্থায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রধান নেতারা বিদেশে, সরকারের ভিত নড়বড়ে, এবং ২০২৬ সালের নির্বাচন সামনে রেখে অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হচ্ছে।
এই প্রেক্ষিতে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন:
“যদি আগামীতে জামায়াত-সংলগ্ন কোনও সরকার গঠিত হয়, তবে ভারতের জন্য তা হবে কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত এক জটিল পরিস্থিতি।আইএসআই ও অন্যান্য ভারত-বিরোধী উপাদান এই সুযোগে সীমানা পেরিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে।”
– সূত্র: Dhaka Stream, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছাত্র রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতির সম্পর্ক: এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে—ছাত্র রাজনীতির প্রবণতা কি সরাসরি জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি? থারুর নিজেও স্বীকার করেন, ছাত্রদের এই অভিমুখ কেবল একটি সূচক, নিশ্চিত ভবিষ্যৎ নয়। তবে এটি অস্বীকার করা যায় না যে, নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করে থাকে।
তরুণ ভোটাররা যদি রাজনীতিতে বিকল্প খুঁজে পান, তবে তারা তা অনুসরণ করতেই পারেন—সেটি যতই অতীতের বিতর্কিত শক্তি হোক না কেন। বাংলাদেশের জন্য এ এক বিপজ্জনক মোড়, যদি না প্রথাগত রাজনৈতিক দল গুলো নিজেদের কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
ভারতের করণীয়: সতর্কতা হোক, শত্রুতার নয়: বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পথ বেছে নেবার অধিকার তার জনগণেরই। ভারতের দায়িত্ব এক্ষেত্রে দ্বিমুখী—একদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ সম্পর্কে সতর্কতা ও প্রস্তুতি, অন্যদিকে হস্তক্ষেপহীন সহযোগিতা ও কৌশলগত সংলাপ।
ভারত যদি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বাস্তবতা গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে এবং নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়, তবে প্রতিবেশী নীতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব।
ড. শশী থারুরের বিশ্লেষণ রাজনৈতিক দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। বাংলাদেশে ছাত্র শিবিরের উত্থান নিছক একটি ছাত্রসংগঠনের জয় নয়, বরং এটি একটি পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক আবহাওয়ার ইঙ্গিত। একে ভয় নয়, বরং সজাগ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ ও গঠনমূলক কৌশলের মাধ্যমে মোকাবিলা করা উচিত।
ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে পরিণত, সহিষ্ণু এবং বহুপাক্ষিক সংলাপ নির্ভর। বাংলাদেশের মতো ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর প্রতি এ দায়িত্ব শুধু কূটনৈতিক নয়, নৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবেও অপরিহার্য।
তথ্যসূত্র:
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com