মো. ফজলে রাব্বি, আখাউড়া।।
দেশে যে কয়েকটি স্থলবন্দর আছে তার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি মূখী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরটিকে শতভাগ রপ্তানিমুখী বন্দর ধরা হয়ে থাকে। আর এ বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য ভারতে যায়-তার প্রায় অর্ধেকেরই বেশি বরফায়িত বিভিন্ন মাছ। তবে গেল কয়েক মাস ধরে ডলারের বিপরীতে রূপির মান কমে যাওয়ায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা মাছ আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে তাজা মাছ পাচারের কারণে মাছ রপ্তানির পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমছে বলে অভিযোগ স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীদের।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৪ সাল থেকে আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে পণ্য রপ্তানি করে আসছেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা। আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক গুরুত্ব বিবেচনায় ২০১০ সালের আগস্টে স্থলশুল্ক স্টেশন থেকে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে আখাউড়া স্থলবন্দর। এ বন্দর দিয়ে বরফায়িত মাছ, পাথর, রড, সিমেন্ট, তুলা, ভোজ্য তেল, এলপি গ্যাস, প্লাস্টিক, ফার্নিচার ও খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে ভারতে। রপ্তানি বাণিজ্য ভালো হওয়ায় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা আমদানি বাণিজ্যে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না।
যদিও গেল কয়েক বছরে উত্তর-পূর্ব ৭ টি রাজ্যর মধ্যে সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে রপ্তানির পরিমাণ কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। বর্তমানে বরফায়িত মাছ, রড, সিমেন্ট, ও প্লাস্টিকসহ হাতে গোনা কয়েকটি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে মাছের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। প্রতি কেজি মাছের রপ্তানি মূল্য আড়াই ডলার।
তবে গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে ডলারের বিপরীতে রূপির মান কমে যাওয়ায় আমদানি খরচ বাড়ার কারণ দেখিয়ে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। আগে প্রতিদিন আড়াই থেকে ৩ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হলেও এখন গড়ে প্রতিদিন রপ্তানি হচ্ছে ১ থেকে দেড় লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের কয়েক ধরনের পণ্য।
বন্দরের সার্বিক রপ্তানি বাণিজ্য কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া আমদানি খরচ মিটিয়ে ভালো মুনাফা না হওয়ায় বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানিও বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা।
আখাউড়া কাস্টমস সূত্রে জানাগেছে, ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ১৫ হাজার ৪৯০ মেঃ টন তাজা মাছ ভারতে রপ্তানি হয়েছে। যার মূল্য ৩২৯ কোটি ১১ লক্ষ ৭ হাজার ৮৪০ টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ১১ হাজার ৪১৩ মেঃ টন মাছ রফতানি হয়েছে। যার মূল্য ২৫২ কোটি ৬৩ লক্ষ ৪৯ হাজার ৩০৫ টাকা। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে (জুলাই হতে ডিসেম্বর ) এই স্থলবন্দর দিয়ে ৪ হাজার ৪৩৭ মেঃ টন মাছ ভারতে রফতানি হয়েছে। যার মূল্য ১১০ কোটি ৬৬ লক্ষ ৭০ হাজার ৪৪৩ টাকা।
স্থলবন্দরের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, এখন শুধুমাত্র মাছের ওপর ভর করেই টিকে আছে স্থলবন্দরের রপ্তানি বাণিজ্য। তবে ডলারের বিপরীতে রূপির মান কমা এবং তাজা মাছ পাচারের কারণে রপ্তানির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আখাউড়া উপজেলার সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে তাজা মাছ পাচার করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। ফলে তাজা মাছ পাওয়ায় বরফায়িত মাছের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। আগে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ টন মাছ রপ্তানি হলেও এখন প্রায় ৪০ শতাংশ কমে রপ্তানি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টনের মতো।
আখাউড়া স্থলবন্দরের মাছ রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো.ফারুক মিয়া বলেন, সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে তাজা মাছ পাচারের কারণে আমাদের বরফায়িত মাছের চাহিদা কমে যাচ্ছে ভারতের বাজারগুলোতে। বিষয়টি আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন ও বিজিবিকে জানিয়েছি। অবৈধ ভাবে মাছ পাচার বন্ধ না করা গেলে-মাছ রপ্তানি বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়বে। এতে করে ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তেমনি সরকারও বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হবে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, রপ্তানি কমায় বন্দরের আয়েও ভাটা পড়েছে। চলমান ডলার সংকট কেটে গেলে, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য আবার গতি পাবে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের মাছ পাচারের অভিযোগের বিষয়টি আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
সীমান্ত দিয়ে মাছ পাচারের অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে পাচাররোধে উপজেলা প্রশাসন। গত বছরের ১৭ নভেম্বর ভোররাতে ভারতে পাচারের চেষ্টাকালে আখাউড়ার গঙ্গাসাগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৭০ কেজি তাজা শিং মাছ জব্দ করে টাস্কফোর্স।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অংগ্যজাই মারমা বলেন, আখাউড়ার সীমান্তবর্তী মনিয়ন্দ ইউনিয়নের সীমান্ত দিয়ে মাছ পাচারের অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এটি রোধে স্থানীয় জন প্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে তৎপর থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যখনই পাচারের তথ্য আসছে, তখনই জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সীমান্ত দিয়ে ভারতে মাছ পাচারের অভিযোগের বিষয়ে সুলতানপুর ৬০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল মুহাম্মদ আশিক হাসান উল্লাহ বলেন, সীমান্ত দিয়ে ভারতে মাছ পাচার হচ্ছে অনেক দিন থেকেই। মাছ যাতে পাচার না হয় সেই বিষয়ে বিজিবি সব সময় সজাগ আছে। বিজিবি কে ম্যানেজ করে পাচারের বিষয়টি সত্য নয়। কোন বিজিবি সদস্য যদি তা করে থাকেন প্রমান পেলে তার বিরুদ্দে কঠোর ব্যাবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, মাছ পাচার রুদে স্থানীয় পুলিশ, উপজেলা প্রশাসনসহ কয়েকটি বাহিনী মিলে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা আছে। এই টাস্কফোর্স এর অভিযান আরো বাড়াতে হবে।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com