ভারত কখনো বাংলাদেশের বন্ধু ছিল না

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ভারতকে মিত্র হিসেবে স্মরণ করা হলেও, অর্ধশতাব্দীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায়—ভারত কখনোই বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু ছিল না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করলেও, ভারতের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা, যা আজও বহাল রয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য, সীমান্ত হত্যাযজ্ঞ এবং কূটনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রায়শই নিঃশ্বাসহীন করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত।
১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা না কৌশলগত বিনিয়োগ?
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সামরিক সহায়তা দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয়ে ভূমিকা রাখে। কিন্তু যুদ্ধের পরই, ১৯ মার্চ ১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দো-বাংলা মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি ছিল ভারতের কৌশলগত মাস্টারস্ট্রোক। এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা নীতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। আন্তর্জাতিক ইতিহাসবিদদের মতে, এটি ছিল বাংলাদেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার, যা বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে তৈরি হয়েছিল।
ফারাক্কা বাঁধ ও পানিবঞ্চনা
বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি নদীনির্ভর। কিন্তু ভারত বারবার একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করেছে।
- ফারাক্কা বাঁধ (১৯৭৫): ভারতের গঙ্গার পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ ও পানিসঙ্কট তৈরি হয়।
- ফারাক্কা লং মার্চ (১৬ মে ১৯৭৬): এ পানিবঞ্চনার প্রতিবাদে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ গণআন্দোলন হয়।
- গঙ্গা চুক্তি (১৯৯৬): নামমাত্র সমঝোতা হলেও, শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ ন্যায্য পানির অর্ধেকও পায় না।
- তিস্তা চুক্তি: ২০১১ সালে চূড়ান্ত হওয়ার কথা থাকলেও ভারতের রাজ্য সরকারের অজুহাতে আজও স্বাক্ষর হয়নি।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়েছে—এটি বাংলাদেশের প্রতি একটি প্রণালীগত অবিচার, যা আমাদের কৃষি, পানীয়জল এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে।
সীমান্ত হত্যা: বিশ্বের অন্যতম রক্তাক্ত সীমান্ত
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বিএসএফের গুলিতে ১,০০০-এরও বেশি বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। সীমান্তে অবৈধভাবে গরু বা অন্যান্য পণ্য আনার অভিযোগে বিনা বিচারে গুলি চালানো হয়। আন্তর্জাতিকভাবে এটিকে “বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী সীমান্ত” বলা হয়। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন বর্বরতা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
নাগরিকহীনতা ও এনক্লেভের অবমাননা
১৯৭৪ সালের ল্যান্ড বাউন্ডারি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, ২০১৫ সালের আগে প্রায় ৫১ হাজার মানুষ নাগরিকহীন ছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা “nowhere people” নামে পরিচিত হয়েছিল। চার দশক ধরে মানুষকে এমন অমানবিক অবস্থায় রাখা বন্ধুত্ব নয়, বৈরিতা।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত
ভারত বারবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে।
- ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভারতের প্রকাশ্য সমর্থন পায় তৎকালীন সরকার, যা গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে।
- ২০২৪ সালে গণআন্দোলনে সরকার পতনের পর শেখ হাসিনা দিল্লিতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকেই ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে।
- আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মতে, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করেছে এবং ভারতের ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার নগ্ন রূপ উন্মোচিত করেছে।
- অর্থনৈতিক আধিপত্য ও বাণিজ্য বৈষম্য
ভারত বাংলাদেশের বন্দর, সড়কপথ ও করিডোর ব্যবহার করে সস্তায় পণ্য পরিবহন করছে, অথচ বাংলাদেশ খুব সামান্য সুবিধা পাচ্ছে।
- ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে আমদানি করেছে ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, কিন্তু রপ্তানি করেছে মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
- বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে ভারতীয় কোম্পানিগুলো আধিপত্য বিস্তার করেছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারতের উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।
- বিশ্লেষকদের মতে, ভারত বাংলাদেশকে চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে “বাফার জোন” হিসেবে ব্যবহার করছে।
- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য
ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করছে। ভারতীয় সিনেমা, টিভি অনুষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপন বাংলাদেশের নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতিকে চাপা দিয়ে ফেলছে। এর ফলে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাও হুমকির মুখে।
আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্র
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রধান লক্ষ্য হলো—বাংলাদেশকে তার প্রভাববলয়ে রাখা। এজন্য তারা—
* বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে।
* সামরিক ও নিরাপত্তা খাতে নিজেদের প্রভাব বাড়ায়।
* সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর ও আকাশপথে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত বাংলাদেশের সার্বভৌম ভূখণ্ডকে একটি কৌশলগত করিডর হিসেবে ব্যবহার করছে, যা প্রকৃত স্বাধীনতার পথে প্রধান অন্তরায়।
১৯৭১ সালে ভারতের সহায়তা ইতিহাসের অংশ হলেও, পরবর্তী ৫০ বছর প্রমাণ করেছে—ভারত কখনোই বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু ছিল না। নদীজল বঞ্চনা, সীমান্ত হত্যাযজ্ঞ, নাগরিকহীনতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক শোষণ এবং আঞ্চলিক আধিপত্যের মাধ্যমে ভারত বারবার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত করেছে।
বন্ধুত্ব মানে পারস্পরিক সম্মান, ন্যায্যতা ও স্বাধীনতা। ভারতের সাথে সম্পর্কের ইতিহাসে এগুলো অনুপস্থিত। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন—স্বাধীন ও সুষম পররাষ্ট্রনীতি, আঞ্চলিক ভারসাম্য, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং ভারতীয় প্রভাবমুক্ত একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রব্যবস্থা।
তথ্যসূত্র
* ইন্দো-বাংলা মৈত্রী চুক্তি, ১৯ মার্চ ১৯৭২
* ফারাক্কা লং মার্চ, ১৬ মে ১৯৭৬
* গঙ্গা জল বণ্টন চুক্তি, ১২ ডিসেম্বর ১৯৯৬
* তিস্তা নদী জলবণ্টন বিরোধ, ২০১১–২০২৫
* ভারত-বাংলাদেশ এনক্লেভ চুক্তি, ১৯৭৪–২০১৫
* মানবাধিকার প্রতিবেদন (হিউম্যান রাইটস ওয়াচ), ২০২৩
* আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গবেষণা (IOSR), ২০২২
* আন্তর্জাতিক জার্নাল (Springer), ২০২৫
