ভালোই চলছে জীবন
।। তৈয়বুর রহমান সোহেল।।
অর্থের মোহে নয়, প্রতিষ্ঠান দেখেও নয়, চারপাশে এত এত অন্যায়-অবিচার-জুলুম দেখে মনে হলো সাংবাদিকতা করা দরকার। সমাজকে বদলে দেয়ার অদ্ভূত নেশা থেকে এ পথে বিচরণ। সমাজ কোথায় গেলো, দেশ কোথায় আছে- এসব প্রসঙ্গ আজ পড়ে থাক।
২০১৩ সাল। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম। ফার্স্ট ইয়ারের ফলাফলের জন্য অপেক্ষমাণ। একটি লজিং আর একটি টিউশনিতে কোনমতে দিন চলে যাচ্ছিল। তার মাঝেই সিদ্ধান্ত নিলাম সাংবাদিকতা করব। ঠাকুরপাড়ার একটি মেসে জেঠাতো ভাই থাকতেন। হাউজিং ব্যবসার কারণে শহরে তার মোটামুটি পরিচিতি ছিল। একদিন সকাল বেলা গিয়ে বললাম, লেখালেখি করতে চাই। আমার জন্য পত্রিকার ব্যবস্থা করেন। পাশে থেকে নাঙ্গলকোটের কায়সার ভাই কথাগুলো শুনছিলেন। তিনি হালকা সাংবাদিকতা করেন। কাজ করেন মূলত কুমিল্লা ইপিজেডে। তিনি আমাদের কুমিল্লার বার্তা সম্পাদক মোল্লা ভাইসহ পূর্বাশা পত্রিকার আরেকজনকে কল করলেন। দুইজনই দেখা করতে বললেন। প্রথমদিন মোল্লা ভাইয়ের সাথে দেখা করি বাগিচাগাঁওয়ের সঞ্চিতা ভিলায়। তিনি কাজের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলেন। বললেন, তোমার কাছে কি লেখা আছে নিয়ে আসো। আমাদের কুমিল্লার প্রয়াত জেনারেল ম্যানেজার মোশারফ ভাই আর তখনকার সার্কুলেশনে কাজ করা রাশেদকে প্রায়ই দেখতাম সামনের বারান্দায় বসে হিসাবনিকাশ করতে।
দুইদিন পর দুটি লেখা নিয়ে মোল্লা ভাইয়ের কাছে হাজির। লেখার মান এমনই, গরম প্রকৃতির কোনো মানুষের হাতে পড়লে নিশ্চিত ধোলাই খেতাম! মোল্লা ভাই বলল, সবার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, বক্তব্য নাই। এমন নিউজ যাবে না। বললেন, চাইলে একটা জিনিস মুখস্থ লেখে দেওয়া যায় না। ওইদিন অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন, তোমার বর্তমান এলাকা ঠাকুরপাড়া নিয়ে কি করা যায় দেখো। আমি বললাম, ছিনতাই বেড়েছে। ছিনতাই নিয়ে প্রথম নিউজ করলাম। তা-ও বক্তব্য নেই! মোল্লা ভাই দেখে একটান দিয়ে ওপরের অংশ কেটে দিলেন। নিচের অংশ রাখলেন। পুলিশের বক্তব্য ছাড়া নিউজ যাবে না বলে দিলেন। দুইদিন পর তিন বন্ধু মিলে টাউনহল গণপাঠাগারের দিকে যাই। তখন আমাদের কুমিল্লার সার্কুলেশন ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এক পাঠককে দেখলাম পত্রিকার ভেতরের পাতা পড়ছে। গভীর মনযোগ দিয়ে আমার নিউজটাই পড়ছে! মনে আনন্দ দোলা দিল। দৌড়ে এসআর ভূঁইয়া অ্যাজেন্টের কাছে গিয়ে তিনটি পত্রিকা কিনে নিই। তখন থেকে কাজ করার উদ্দীপনা বেড়ে গেলো। একমাস পর মোল্লা ভাই আমাদের কুমিল্লার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক শাহাজাদা ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আন্তরিকতার সাথে কথা বললেন। পরিস্থিতির কারণে সাংবাদিকতা যেমনই করি, তিনি কখনো কোনো নিউজ প্রকাশে কার্পণ্য কিংবা অসততা প্রদর্শন করেননি। যেটা বাড়তি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
দিনদিন পড়াশোনার চাপ বাড়তে লাগলো। অনার্স প্রথম বর্ষে চার বিষয়ে ফেল। গণিত যেন কিছুতেই মাথায় থাকে না। উপার্জন নেই বললেই চলে। অদক্ষতার কারণে বাইরে কেউ রেসপন্স করতো না। এভাবে আড়াই বছর আশা-নিরাশায় চলে গেলো। নানা জায়গায় আইডি কার্ডের জন্য হয়রানির শিকার হচ্ছি। আড়াই বছর পর অফিস থেকে টেম্পোরারি আইডি কার্ড দেওয়া হয়। সপ্তাহে দুইদিন প্রুফ রিডিংয়ের জন্য মাসে এক হাজার টাকা সম্মানির ব্যবস্থা করা হয়। ২০১৫ সালের শেষদিকে এ উপার্জনটাও বন্ধ হয়ে যায়। টিউশনি-লজিংয়ের বাসার সবার মন খারাপ। সাংবাদিকতার কারণে তাদের সন্তানদের সময় দিতে নাকি অবহেলা করছি। এদিকে অফিসেও ঠিকমতো যাওয়া বন্ধ, বাড়ি থেকেও বাড়তি চাপ, সাথে গণিতের মতো কঠিন বিষয়ে পড়ার বিড়ম্বনাতো ছিলই। মাঝে চাপে পড়ে লজিং ছেড়ে দিই। আবার শুরু হয় অন্যরকম সংগ্রাম।
… কখনো হারিয়ে যাই, কখনো ফিরে আসি। এভাবে নয়টি বছর কেটে গেছে। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা জীবনে কিছু পাইনি তা বলা যাবে না। পেয়েছি মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইয়ের মতো এক যোদ্ধাকে। আমার গোঁজামিল-এলোমেলো সাংবাদিকতায় তিনি কখনো বিরক্ত হননি। প্রতিনিয়ত শেখার সুযোগ থাকা ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। সাথে খানাপিনা কমিটির সতীর্থরা আছেই! ভালোই চলছে জীবন।
লেখক:কুমিল্লা প্রতিনিধি,দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও বাংলানিউজ ২৪.কম।