মক্তব: জ্ঞানের প্রথম দরজা

।। শরীফ প্রধান।।

inside post

ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৬টা ৩০-এ। মসজিদের মাইকে ভেসে আসছে পরিচিত কিছু শব্দ—“মক্তবের সকল শিক্ষার্থী আরবি শিক্ষার জন্য দ্রুত মসজিদে চলে আসো। অভিভাবকরা আপনাদের সন্তানদের দ্রুত মসজিদে পাঠান।”
ইমাম সাহেব বারবার উচ্চারণ করছেন এই আহ্বান।

ফজরের নামাজ মাত্র শেষ হয়েছে। জায়নামাজেই বসা ছিলাম। মাইকের সেই ডাক কানে আসতেই স্মৃতির দরজা খুলে গেল।
আমাদের গ্রামে তখন একটাই মসজিদ ছিল। শীতের কুয়াশা উপেক্ষা করে ঘুম ঘুম চোখে ছুটে যেতাম মক্তবে। আর এই পুরো আয়োজনের প্রধান সংগঠক ছিলেন মা। ফজরের নামাজের পর মা আমাদের তৈরি করে দিতেন, হাতে ধরিয়ে দিতেন কখনো পোড়া আলু, কখনো বিস্কুট বা মুড়ি। সেই খাবার মুখে দিয়ে দৌড়ে যেতাম মসজিদে, যেখানে অপেক্ষা করতেন হুজুর ও আমাদের সহপাঠীরা।

কিন্তু মাঝে মাঝে কুয়াশার চাদরে মোড়ানো সকাল, কিংবা ঝুম বৃষ্টি আমাদের অলস করে দিত। তখন নানা অজুহাত তৈরি করতাম— শরীর ভালো লাগছে না, পেটব্যথা করছে। কিন্তু মা ছিলেন কঠোর। মক্তবে যেতেই হবে! কখনো আদর করে, কখনো শাসন করে আমাদের নিয়ে যেতেন তিনি।

মক্তব: এক টুকরো স্বর্গ

মক্তবে আমাদের সমাজের সব ছেলে-মেয়েরা আসত। সেখানে আলাদা গ্রুপ ছিল—
• যারা সূরা ও কায়দা পড়ত,
• যারা আলিফ-লাম-মীম শিখত,
• আর যারা পুরো কুরআন পড়ত, তারা ছিল সবার সিনিয়র।

কুরআন শেখার আনন্দ ছিল একেবারে ভিন্ন। কোনো শিক্ষার্থী যখন কুরআন শুরু করত, পুরো মক্তব যেন উৎসবের আবহে ভরে যেত। কারণ, কুরআন শেখার প্রথম দিনে তাকে বিস্কুট নিয়ে আসতে হতো। তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় বিস্কুট ছিল “সুপার বিস্কুট”। আমরা সবাই মুখিয়ে থাকতাম, কখন নতুন কেউ কুরআন শুরু করবে, আর আমরা ভাগে ভাগে বিস্কুট পাবো!

মক্তবে আমাদের মধ্যে ছিল শৃঙ্খলা, পারস্পরিক ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও সামাজিক বন্ধন। আমরা একসঙ্গে বসতাম, একসঙ্গে শিখতাম। ছোটবেলা থেকেই শিখতাম শ্রদ্ধা, শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক সহমর্মিতা।

মক্তব: জ্ঞানের প্রথম পাঠশালা

মক্তব শুধু কুরআন শেখার জায়গা নয়, এটি আমাদের জীবনের প্রথম শিক্ষালয়। এখানে আমরা শিখেছি—
• কুরআন মাজিদ, সূরা, কিরাত, দোয়া-দরুদ ও আদব-কায়দা
• সততা, শৃঙ্খলা, নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ জীবনযাপন
• বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা
• সহমর্মিতা ও দলবদ্ধভাবে চলার শিক্ষা

আমাদের জীবনের প্রথম শিক্ষা শুরু হয়েছিল মক্তবে, আর সেটাই আজও পথ দেখায়। মক্তবে পড়া শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনেও এর সুফল বয়ে আনে।

আজকের সমাজ ও মক্তবের গুরুত্ব

কিন্তু আজকের দিনে কী ঘটছে?
আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমরা যেন সেই মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছি। ফজরের আজান শোনার মতো অনেক মায়ের কানেই হয়তো আর শব্দ পৌঁছায় না। অনেক সন্তান জানেই না মক্তব কী!

কিন্তু আদর্শ সন্তান গড়ে তুলতে হলে মক্তবের শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। মায়েরাই সন্তানের প্রধান শিক্ষক। তাই মা যদি নিজেকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন, সন্তানও সেই আদর্শ দেখে শেখে।

শেষকথাঃ
আমাদের মক্তব ছিল আমাদের রঙিন শৈশবের এক টুকরো স্বর্গ।সেখানে শীতের সকালে দৌড়ে দৌড়ে মসজিদে যাওয়া ছিল আনন্দ।সেখানে আমরা শিখেছিলাম নৈতিকতা, সততা, পরিশ্রম ও দায়িত্ববোধ। সভ্যতা যতই উন্নত হোক, মক্তবের শিক্ষা ছাড়া আদর্শ মানুষ গড়া সম্ভব নয়।কারণ, মক্তবই আদর্শ মানুষ তৈরির সূতিকাগার ও জ্ঞানের প্রথম দরজা।

লেখক:
সাংবাদিক ও সংগঠক।
01675785122

আরো পড়ুন