প্রিন্ট এর তারিখঃ জুন ২৬, ২০২৫, ৪:৩৮ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুন ২৫, ২০২৫, ৩:৫৩ অপরাহ্ণ

মনোয়ার হোসেন রতন।।
বর্তমান পৃথিবী আবার উত্তপ্ত। একদিকে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ। মধ্যপ্রাচ্য যেন পরিণত হয়েছে এক বিস্ফোরণভূমিতে, যেখানে আগুন জ্বলছে শুধু ভূখণ্ডে নয়—জ্বলছে ইতিহাস, রাজনীতি এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও। আর এই সংকট-নির্মাণের মূল কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তৃত সামরিক ঘাঁটি।
মার্কিন সামরিক ঘাঁটির চিত্র:
সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত ২৯টি সক্রিয় ঘাঁটি পরিচালনা করছে, যার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য:
আল-উদেইদ এয়ারবেস (কাতার): মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি, যেখানে প্রায় ১০,০০০ সেনা মোতায়েন।
নেভাল বেস (বাহরাইন): মার্কিন পঞ্চম নৌবহরের কেন্দ্র, পারস্য উপসাগরে আধিপত্য রক্ষার অন্যতম মাধ্যম।
আইন আল-আসাদ ও হারির ঘাঁটি (ইরাক): ইরাক যুদ্ধের সময় নির্মিত, এখনো মোতায়েন মার্কিন বাহিনী।
তানফ ঘাঁটি (সিরিয়া): আইনবিরুদ্ধ দখলদারি ঘাঁটি, ইরান-ইরাক-সিরিয়া সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কৌশল।
আরও রয়েছে: সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, জর্ডানে স্থায়ী বা অস্থায়ী ঘাঁটি।
মার্কিন ঘাঁটির লক্ষ্য কী?
ইরানকে ঘিরে রাখা: মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটির অবস্থান যেন এক ঘূর্ণিপাকের মতো ইরানকে কেন্দ্র করে তৈরি। ইরান যাতে সিরিয়া, লেবানন কিংবা ইয়েমেনে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সেটাই মূল লক্ষ্য।
ইসরায়েলের নিরাপত্তা: মধ্যপ্রাচ্যের যত ঘাঁটি—তার প্রতিটি যেন একেকটি ঢাল ইসরায়েলের চারপাশে।
প্রাকৃতিক সম্পদের দখলদারি: বিশেষ করে সিরিয়া ও ইরাকের তেলক্ষেত্রের নিরাপত্তার নামে লুটপাট।
চীন ও রাশিয়ার বলয় ঠেকানো: নতুন শীতল যুদ্ধের বাস্তবতা এখানে রূপ নিচ্ছে সামরিক ঘাঁটির মাধ্যমে ভূ-রাজনীতির পাল্টা চাল হিসেবে।
সংঘর্ষের নতুন অধ্যায়:
২০২৪-২৫ সালে নতুন করে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা জোরালো হয়েছে। একাধিক রকেট হামলা, সিরিয়ার দমাস্কাসে ইসরায়েলি হামলা, এরপর ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া—এই সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্র আবারো সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এগিয়ে এসেছে।
এই প্রসঙ্গে ইরাক ও সিরিয়ার প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো একাধিকবার মার্কিন ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। ইরানি সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো স্পষ্ট করে বলেছে:
“যতদিন আমেরিকার সেনা আমাদের ভূমিতে থাকবে, প্রতিরোধ চলবে।”
প্রতিরোধের হাহাকার:
ইরাকের হাশদ আল শাবি, সিরিয়ার সরকারি বাহিনী, ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ—তারা সবাই বিশ্বাস করে, মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি এই মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো।
অথচ তথাকথিত গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশে সামরিক ঘাঁটি গড়াকে ‘নিরাপত্তার প্রয়োজন’ বলে প্রচার করে, কিন্তু ইরান বা অন্য রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোকে ‘উসকানি’ হিসেবে আখ্যা দেয়। এটিই আজকের বৈশ্বিক দ্বিচারিতার মুখ।
শেষ কথা
মধ্যপ্রাচ্য আর যুদ্ধ চায় না। রক্ত চায় না, গোলাবারুদের ঝলকানি চায় না। কিন্তু যতদিন মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো এই ভূখণ্ডে গেঁথে থাকবে, ততদিন এই অঞ্চল শোষণের শেকলেই বাঁধা থাকবে।
এ যেন উপনিবেশবাদের নতুন রূপ—“ঘাঁটি দিয়ে ঘিরে রাখো, আগ্রাসনকে বৈধ করো।”
ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, মধ্যপ্রাচ্যের মাটি থেকে মার্কিন ট্যাঙ্ক উঠে গেলে তবেই এখানে শান্তির অঙ্কুর ফুটবে।
তথ্যসূত্র:
Al Jazeera, Middle East Monitor
US Central Command (CENTCOM) Reports
SIPRI Database
The Intercept, Amnesty Reports