।। আমিনুল ইসলাম সজীব ।।
মানুষের জীবন যেন এক অনন্ত পথচলার ক্ষণিক বিরতি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই স্বল্প সময়ের ভেতর কেউ হয়ে ওঠে কালের যাত্রী, কেউ বা ইতিহাসের আলোছায়ায় হারিয়ে যায়। অনেকে জীবনের ব্যস্ত ঢেউয়ে শুধু নিজের ঘরটুকুই গড়তে ব্যস্ত থাকেন—তাদের অস্তিত্ব একদিন সময়ের অতলে নিঃশব্দে হারিয়ে যায়। অথচ কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা নিজের সুখ-দুঃখের সীমা ছাড়িয়ে হাত বাড়ান অন্যের দিকে—অসহায়ের কান্নায় হৃদয় কাঁপে, দুঃখীর মুখে হাসি ফুটাতেই যাঁদের জীবনের সার্থকতা। তাঁরা শিখিয়ে যান—জীবন মানে কেবল বাঁচা নয়, বরং অন্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা, মানবতার আলো ছড়িয়ে যাওয়ার নামই প্রকৃত জীবন। এরা মৃত্যুর পরও মুছে যান না; তাদের কর্ম, ভালোবাসা, আর হৃদয়ের উত্তাপ শতাব্দী পেরিয়েও মানুষের মনের গহীনে দীপ্ত হয়ে থাকে।
জীবন তখনই মহৎ হয়, যখন তা নিজেকে ছাড়িয়ে অন্যের মাঝে খুঁজে পায় অর্থ—যখন হৃদয়ের ধর্ম হয়ে ওঠে "মানবতা"।
মানুষ কেবল ভোগের জন্য জন্মায়নি। কেবল নিজের খাবার, পোশাক, আশ্রয়, আরাম-আয়েশ—এসবের পেছনে ছুটে চলাই জীবন নয়। বরং প্রকৃত জীবন তখনই শুরু হয়, যখন কেউ তার সীমানা পেরিয়ে, নিজের প্রয়োজনের বাইরে গিয়ে অন্যের কথা ভাবে। মানুষের জন্য কাজ করাই হচ্ছে মনুষ্যত্বের প্রমাণ। আজ আমাদের চারপাশে লোকের অভাব নেই, কিন্তু মানুষের অভাব প্রকট। আমাদের চারপাশে মানুষের অভাব নাই, কিন্তু মনুষ্যত্বের বড়ই অভাব।
পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে মানবতা। পশুরাও খাদ্য খায়, নিরাপত্তা খোঁজে, বংশবৃদ্ধি করে। কিন্তু তারা অন্যের দুঃখে কাঁদে না, ক্ষুধার্তকে আহার দেয় না, শোকাহতকে সান্ত্বনা দেয় না। মানবতা সেই অনন্য গুণ, যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে, মহিমান্বিত করে। আর এই মানবতাই আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন।
মানবতার গুরুত্ব শুধু নীতিকথায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং ধর্মীয় মূল্যবোধেও তার গভীর শিকড় রয়েছে। আল্লাহ বলেন— نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ ٱللَّهِ ۖ لَا نُرِيدُ مِنكُمْ جَزَآءًۭ وَلَا شُكُورًا
“তারা খাদ্য দান করে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতিম ও বন্দিকে, যদিও তারা নিজেরাও তা ভালোবাসে। তারা বলে, ‘আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তোমাদের খাওয়াচ্ছি; তোমাদের কাছ থেকে আমরা কোন প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতাও চাই না। (১)
আয়াতে মানবতার এক অপূর্ব দৃশ্যচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এখানে এমন মানুষের কথা বলা হয়েছে, যারা নিজে অভাবী হয়েও তারা তা দিয়ে দেয় একজন অভাবী, একজন ইয়াতিম আর একজন বন্দিকে। শুধু তাই নয়, তারা বলে, “আমরা তোমাদের খাওয়াচ্ছি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তোমাদের কাছ থেকে আমরা কোনো প্রতিদান বা ধন্যবাদ চাই না।” এই আয়াত আমাদের শেখায়, মানুষের উপকার করার আসল সৌন্দর্য তখনই প্রকাশ পায় যখন তা নিঃস্বার্থ হয়। কাউকে সাহায্য করার পর যদি কিছু প্রত্যাশা না থাকে, সেটাই সবচেয়ে পবিত্র দান। এটা এমন এক ভালোবাসা, যা শুধু আল্লাহর জন্য—নীরবে, নিঃশব্দে, হৃদয় দিয়ে। (২)
ইসলামের ইতিহাসে মানবতার এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছিল ইয়ারমুক যুদ্ধের ময়দানে। এই যুদ্ধে তিনজন আহত সাহাবি—হযরত হিশাম ইবনুল আস (রাঃ), হযরত ইকরিমা ইবনে আবু জাহল (রাঃ) এবং হযরত হারিস ইবনে হিশাম (রাঃ)—গুরুতর জখম হয়ে মাটিতে পড়ে ছিলেন।
একজন মুসলিম পানি নিয়ে প্রথমে গেলেন হযরত হিশাম (রাঃ)-এর কাছে। তিনি তৃষ্ণার্ত ছিলেন, কিন্তু পানি পানের আগেই আশপাশে একজন আহত সাহাবির কাতর শব্দ শুনে বললেন, “উনাকে আগে দিন।”
তিনি গেলেন ইকরিমা (রাঃ)-এর কাছে। তিনিও পানি না খেয়ে পাশের সাহাবির কথা বললেন—“ওনার তৃষ্ণা আমার চেয়ে বেশি।”
এরপর তিনি হারিস (রাঃ)-এর কাছে গেলেন, কিন্তু ততক্ষণে তিনি শহীদ হয়ে গেছেন।
ফিরে এসে দেখলেন, হিশাম (রাঃ) ও ইকরিমা (রাঃ)-ও মৃত্যুবরণ করেছেন। (৩)
তিনজন সাহাবিই নিজের পিপাসা না মিটিয়ে অন্যের জীবন বাঁচাতে চেয়েছিলেন।
এই ঘটনাটি মানবতার এমন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা বিশ্ব ইতিহাসেও বিরল।
শুধু ইসলাম নয়, পৃথিবীর সব ধর্মই মানুষকে শেখায় মানবতার মর্মবাণী। প্রতিটি ধর্মের মূলেই রয়েছে মমতা, দয়া আর সহানুভূতির অমল ধারা। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—যে সকল প্রাণীর প্রতি সমবেদনা দেখায়, সেই-ই প্রকৃত জ্ঞানী।, (৪) এখানে জ্ঞানের মানদণ্ড হিসেবে তিনি বইয়ের পাণ্ডিত্য নয়, হৃদয়ের কোমলতা ও করুণার মূল্য দিয়েছেন।
যিশু খ্রিস্টের বাণী—“Love your neighbor as yourself”—(৫) শুধু একটি বাক্য নয়, এটি এক মহান জীবনদর্শন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—নিজেকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভালোবাসতে হবে পাশের মানুষটিকেও। এ ভালোবাসা শুধু মুখের কথা নয়, তা প্রকাশ পায় আমাদের ব্যবহারে, আচরণে, সহানুভূতিতে।
গৌতম বুদ্ধও দিয়েছেন এক অমূল্য বার্তা—“যে অন্যের দুঃখকে নিজের মনে করে, সেই-ই সত্যিকারের মানুষ।” (৬) এই কথায় ফুটে উঠেছে মানুষের আসল সৌন্দর্য—সহানুভূতির গভীরতা।
কেবল ধর্মেই নয়, বাংলা সাহিত্যের কবি ও সাহিত্যিকরাও মানবতার এই বোধকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চারণ করেছেন—
“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!” (৭)
এই পঙক্তির মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলাম মানবতাকে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, কোনো ধর্ম, জাতি, ভাষা, পদমর্যাদা বা সামাজিক অবস্থান নয়—মানুষ হিসেবেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত। এখানে "মানুষ" শব্দটি শুধুই শারীরিক অস্তিত্ব নয়, বরং ন্যায়, সহানুভূতি, ভালোবাসা, প্রতিবাদ, ও ন্যায়বোধে উদ্ভাসিত এক মানবসত্তার প্রতীক।
জীবনানন্দ দাশ গভীর প্রশ্ন রেখেছেন—
“মানুষ যদি সে না হয়, তবে সে মানুষ কেন?” (৮)
এখানে কবি আমাদের মনে করিয়ে দেন—মানুষ হওয়া মানে শুধু দেহে মানুষ নয়, গুণেও মানুষ হওয়া। যার মধ্যে দয়া নেই, ভালোবাসা নেই, ন্যায়বোধ নেই—সে মানুষ নামে মানুষ, আসলে নয়। এই প্রশ্ন আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়—আমরা কি সত্যি মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখি—আজকের পৃথিবী প্রতিযোগিতায় ভরা, ভবিষ্যৎ গড়ার দৌড়ে আমরা অনেকেই ছুটে চলেছি। কিন্তু এই দৌড়ে মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেললে আমরা হয়তো সফল নাগরিক হবো, কিন্তু পরিপূর্ণ মানুষ হবো না। প্রযুক্তি শেখো, বিজ্ঞান জানো, অর্থনীতির ব্যুৎপত্তি বোঝো—সবই প্রয়োজন। কিন্তু তার সঙ্গে যদি হৃদয়ে না থাকে সহমর্মিতা, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ ও মানবতা তবে সেই জ্ঞান নিষ্প্রাণ, রোবটের মতো। আধুনিক সমাজে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে আত্মকেন্দ্রিকতা। আত্মার জায়গা দখল করছে যন্ত্র। সম্পর্কগুলো ক্রমে হয়ে উঠছে স্বার্থনির্ভর। এমন সময়েই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানবতার আলো।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, মানবতা শব্দটির অপব্যবহারও কম নয়। মানবতা শব্দটি আজ অনেকেই ভুলভাবে ব্যবহার করেন। কাউকে একমুঠো ভাত দেওয়া, গরিবকে একটি পুরোনো জামা দান করা, বা অসহায়ের মাথায় করুণা ভরা হাত বুলিয়ে দেওয়া—এসবই যেন মানবতার সংজ্ঞা হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই করুণাপ্রসূত আচরণে অনেক সময় লুকিয়ে থাকে আত্মগর্ব, ক্ষমতার আস্ফালন আর নিঃস্ব মানুষটির সম্মানহানির ভয়াবহতা—তা আমরা অনুধাবন করি না।
মানবতা মানে কাউকে দয়া করা নয়, বরং তাকে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। কোনো ক্ষুধার্তকে একবেলা খাওয়ানো বড় কথা নয়; বরং সে যাতে নিজে উপার্জন করে সম্মানের সঙ্গে আহার করতে পারে, সেই পথ দেখানোই হচ্ছে প্রকৃত মানবকল্যাণ। সাহায্য যদি মানুষকে চিরকাল আশ্রয়প্রার্থী করে রাখে, তবে তা উপকার নয়—নৈরাশ্য সৃষ্টি। আর যদি সাহায্য মানুষকে শক্তি দেয়, আত্মবিশ্বাস দেয়, তবে তা সত্যিকার অর্থে মানবিক কাজ।
মানুষের বিপদে নিঃস্বার্থভাবে পাশে দাঁড়ানো—এই হল মানবতার নির্যাস। সাহায্য করতে গিয়ে নিজেকে উচ্চস্থানে ভাবা কিংবা প্রাপ্ত কৃতজ্ঞতার আশায় থাকা মানবতার অবমাননা। মানুষকে মানুষ ভাবতে হবে, করুণা নয়—সহমর্মিতার চোখে দেখতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই মানুষকে মানুষের কাছাকাছি আনে, ভেদাভেদ ভাঙে, সমাজে সৃষ্টি করে আন্তরিকতার বন্ধন।
এই ভাবনার নিখুঁত উদাহরণ রেখে গেছেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। এক গরিব সাহাবি তাঁর কাছে সাহায্য চাইলে, তিনি সরাসরি কিছু দান করেননি। বরং জিজ্ঞেস করলেন তার ঘরে কী আছে। সাহাবি একটি চাদর ও একটি পেয়ালার কথা বললে, রাসুল (সা.) সেগুলো নিলামে বিক্রি করে একটি কুড়াল কিনে দিলেন এবং তাকে কাঠ কেটে উপার্জন করতে বললেন। (৯)
এই ঘটনাটি আমাদের শিক্ষা দেয়—মানবতা মানে কেবল মুখে আহার দেওয়া নয়, বরং কারও জীবনে স্থায়ী পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করা। করুণার বদলে সম্মান দিয়ে, সাহায্যের নামে নির্ভরতাকে নয়—উৎপাদনশীলতা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন গঠনের দিশা দেখানোই মানবতার প্রকৃত প্রকাশ।
সুন্দর পৃথিবী গড়তে আমাদের সবাইকে মানবিক হতে হবে। সহানুভূতি ও সম্মানের আলোয় আমরা সমাজকে উজ্জীবিত করবো। শুধু সাহায্য নয়, মর্যাদাপূর্ণ জীবন গড়ার পথ দেখানোই হবে প্রকৃত মানবিকতা। এই মূল্যবোধে নতুন প্রজন্মের জন্য শান্তি ও সৌহার্দ্যের পৃথিবী রচিত হবে। তাই চলুন, মানবিক হৃদয় নিয়ে এক সুন্দর পৃথিবী গড়ার পথে এগিয়ে যাই।
মানবতার কল্যাণকামী মানুষদের জন্যেই সমাজে এখনও কিছু আলো জ্বলে। তারা চিরকাল জীবিত থাকতে না পারলেও তাদের কর্ম ও ভালোবাসা তাদের জীবন্ত করে রাখে যুগের পর যুগ, হৃদয়ের পর হৃদয়।
এটাই একজন মানুষের সবচেয়ে বড় সার্থকতা—মাটির নিচে থেকেও আলো ছড়ানো।
সত্যিকারের মানুষের কীর্তি কেবল কালের আয়নায় নয়, মানবতার গর্ভে চিরজীবী হয়ে থাকে।
১। সূরা দাহর ৭৮:৮-৯
২। তাফহিমুল কোরআন, তাফসির ইবনে কাসীর
৩। "ইয়ারমুক যুদ্ধ ও সাহাবীদের বীরত্ব"
লেখক: ড. রাগেব সারজানি
৪। শ্রীমদ্ভগবদ গীতা"
অনুবাদক: স্বামী তপোবন মহারাজ
৫। "The Holy Bible – New International Version"
প্রকাশক: Zondervan
রেফারেন্স: Matthew 22:39
৬। "ধম্মপদ (Dhammapada)"
অনুবাদক: ভিক্ষু শীলানন্দ
প্রকাশক: বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ।
৭।"মানুষ" – কবিতা, কাজী নজরুল ইসলাম
উৎস: কাজী নজরুল ইসলাম রচনাবলী (খণ্ড ২)
৮।"বনলতা সেন" – জীবনানন্দ দাশ
উৎস: বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ।
৯।সুনান আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ১৬৪১
অন্যান্য প্রন্থপঞ্জি:
"কুরআনের আলোকে মানবতা"
লেখক: মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী
"রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মানবিক জীবন"
লেখক: ড. আলী মোহাম্মদ আস-সাল্লাবি
"হাদীসের আলোকে মানবতা"
লেখক: মুফতি তাকী উসমানী
"The End of History and the Last Man"
লেখক: Francis Fukuyama
আধুনিক সভ্যতা ও মানব মূল্যবোধ
প্রকাশক: Free Press।
মানব কল্যান
লেখক : আবুল ফজল।
লেখক:
প্রভাষক (বাংলা)
রূপসী বাংলা কলেজ, কুমিল্লা।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com