।। মনোয়ার হোসেন রতন ।।
রাজনীতি—শুধু শাসনের কৌশল নয়, এটি এক বহুমাত্রিক সমাজপ্রক্রিয়া, যেখানে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছিলেন, “Man is a political animal”—মানুষ রাজনৈতিক জীব। তাই সভ্যতার আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত রাজনীতি নানা রূপে বদলেছে, কিন্তু একটি জিনিস অপরিবর্তিত থেকেছে—ক্ষমতার প্রতি মানুষের সীমাহীন আসক্তি।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, রাজনীতির বিভিন্ন রূপ ও ধারা ছিল:
এ ধারাগুলোর বাইরে এখন এক নতুন সংস্করণ দেখা যাচ্ছে—“ফ্যামিলি পলিটিক্স” বা “পারিবারিক রাজনীতি”। এটি গণতন্ত্রের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা এক আধুনিক রাজতন্ত্র, যেখানে নেতৃত্ব আসে রক্তের উত্তরাধিকার থেকে, আদর্শ বা কর্মের ভিত্তিতে নয়।
বিশ্ব ইতিহাসে পারিবারিক শাসনের প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে—মিশরের ফিরাউন থেকে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র, ভারতের মৌর্য, গুপ্ত, মুঘল কিংবা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই পরিবার ছিল ক্ষমতার কেন্দ্র। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়।
১৯৭১ সালে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রের জন্ম, সেখানে স্বাধীনতার পরেই ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ শুরু হয় পরিবারের হাতে। শুরুতে তা "ঐতিহ্য" ও "স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা" নামে গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা রূপ নেয় একচ্ছত্র পারিবারিক আধিপত্যে।
আজকের বাস্তব চিত্রে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই—বাংলাদেশের রাজনীতি কার্যত দুইটি বৃহৎ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। দলীয় কাউন্সিল, উপদেষ্টা পরিষদ কিংবা নির্বাচনী ব্যবস্থার চেয়ে একটি পরিবারের ইচ্ছা এখন অনেক বেশি প্রভাবশালী। দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বললেই চলে।
নতুন প্রজন্মের মেধাবী ও কর্মঠ নেতারা পদ পেতে পারেন না, কারণ তাঁদের রক্তে “উত্তরাধিকার” নেই। বরং পদ পান তারা, যারা শুধুমাত্র পরিবারের সদস্য বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। “বিশ্বাস”, “আদর্শ”, “ত্যাগ” এখন শুধুই স্লোগান; কাজের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় রক্তসম্পর্ক ও আনুগত্য।
এ বাস্তবতা কতটা বেদনাদায়ক তা কিছু উদাহরণেই স্পষ্ট—
রাজনীতি আজ আর ত্যাগ ও আদর্শের কথা বলে না, বলে— “আমার বাবা কে ছিলেন”, “আমি কার ভাই/ছেলে”, “আমরা ঐতিহ্যবাহী পরিবার”।
ফ্যামিলি পলিটিক্স এমনই এক কৌশল, যেখানে গণতন্ত্রের শরীরকে ব্যবহার করে রাজতন্ত্রের আত্মা প্রতিষ্ঠিত হয়। ভোটাধিকার, নির্বাচন, সাংবিধানিক কাঠামো সব কিছু থাকলেও, সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে পরিবার। একে কি আর গণতন্ত্র বলা চলে?
আমরা এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বসবাস করছি, যেখানে—
এ ব্যবস্থায় নতুন নেতৃত্বের জন্ম হয় না, কেবল উত্তরসূরি জন্ম নেয়।
অতএব প্রশ্ন জাগে—এটি কি প্রকৃত গণতন্ত্র, না কি পরিবারতন্ত্রের আধুনিক মুখোশ?
রাজনীতিকে যদি আমরা আবার আদর্শ ও মানুষের কল্যাণে ফিরিয়ে নিতে চাই, তবে দরকার নতুন রাজনৈতিক চেতনা, যেখানে নেতৃত্ব জন্ম নেবে—
তবেই সম্ভব এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে নেতৃত্ব হবে “যোগ্যতার অধিকার” আর জনগণ হবে “নির্ধারক শক্তি”।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com