পৃথিবীর সব জাতিরই সুনির্দিষ্ট কিছু উৎসব রয়েছে। ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগেও আরবে নওরোজ ও মেহেরজান নামের দুটি উৎসব ছিল। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের এর চেয়ে উত্তম দুটি উৎসব উপহার দেন। তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এক মাস সিয়াম সাধনার পর পয়লা শাওয়াল পালন করা হয় ঈদুল ফিতর। আর ১০ জিলহজ্ব পালন করা হয় ঈদুল আদহা। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানুল মোবারকে সাওম ফরজ হয়। একই হিজরিতে ঈদুল আদহার সালাত ও কোরবানির বিধানও অবতীর্ণ হয়।হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন তাদের দুটি দিন ছিল, যাতে তারা উৎসব পালন করত। তিনি জিজ্ঞেস করেন, এ দুটি কিসের দিন? তারা বলল, আমরা জাহেলি যুগে এ দুই দিন খেলাধুলা ইত্যাদি উৎসব পালন করতাম। এ নিয়মই চলে আসছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দুটি দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আদহা (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১১৩৬; মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ১৩৬৪৭)
ঈদ প্রতিবছর সাজগোজ, আনন্দ-খুশি ও নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে ফিরে আসে। এ কারণে ঈদের দিনকে আনন্দ ও খুশির দিন বলা হয়। অভিধানে বলা হয়েছে, ঈদকে এ জন্য ঈদ বলা হয় যে তা প্রতিবছর নতুন আনন্দ ও খুশি নিয়ে ফিরে আসে। কোরআন মজিদেও ঈদ শব্দের ব্যবহার রয়েছে; যেমন মরিয়ম তনয় ঈসা বলল, হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন, তা আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার জন্য হবে ঈদ-আনন্দোৎসব এবং আপনার পক্ষ থেকে একটি নিদর্শন (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১১৪)। এই আয়াতে আসমানি খাদ্য নাজিল হওয়ার দিনটি পরবর্তীদের জন্য স্মৃতিচারণার দিন হওয়ায় তাকে ঈদ বলা হয়েছে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এবং সাহাবারা তাঁদের জীবনে দেখিয়েছেন এ উৎসবের তাৎপর্য। কীভাবে তাঁরা ঈদ পালন করতেন এবং কীভাবে ঈদের দিন সময় কাটাতেন, সেদিকে তাকালেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়।যার প্রতিটি ধাপে ও উদ্যোগে ছিল সৌন্দর্য চর্চা ও শুদ্ধারের সুতীব্র প্রভাব। আনন্দের সাথে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার এক মিশ্রিত অনুভূতিতে নিজেদের তারা সমৃদ্ধ করেছে। যা সর্বকালে কালজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকবে। আসুন প্রিয় নবীর ঈদ উৎসব কেমন ছিল জেনে নেই।
মহানবী (সা.) ঈদের দিনে গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করাকে গুরুত্ব দিতেন।ইবনে উমর (র.) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে, ‘তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।’ [সুনান বায়হাকী : ৫৯২০]তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে উত্তম পোশাক পরতেন।ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেছেন : ‘নবী কারীম (সা.) দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন।’ [যাদুল মায়াদ] ঈদুল ফিতরের দিনে দয়াল নবী (সা.) কিছু মিষ্টি দ্রব্য খেতেন। ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা উত্তম। বুরাইদা (র.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারীম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না।’
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (র.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন : ‘আল্লাহ রাববুল আলামিন তাঁর বান্দার ওপর তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।’ [সহীহ আলজামে : ১৮৮৭] রাসূল (স.) ঈদুল ফিতরের নামাজে কিছু বেজোড় সংখ্যক খেজুর না খেয়ে কখনোই যেতেন না। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেছেন, ঈদুল ফিতরের নামাজে রাসূল (সা.) কিছু খেজুর না খেয়ে কখনোই যেতেন না। তিনি সাধারনত বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন। (বুখারী)নবীজি (স.) দিনে বের হয়ে দুই রাকাত ঈদের সালাত আদায় করতেন। [সহীহ বুখারি : ৯৮৯] সালাত শেষে খুতবা দিতেন। রাসূল (সা.) পুরুষ, নারী, শিশু, বৃদ্ধ এমনকি ঋতুমতী নারীকেও ঈদের নামাজের জাময়াতে আসার জন্য উৎসাহিত করেছেন। ঈদুল ফিতরের নামাজের জন্য জামায়াতে আসার আগে রাসূল (সা.) তাকবীর পড়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। ঈদের তাকবীর হল,(আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লালাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ)
আবদল্লাহ বিন সায়েব (র.) থেকে বর্ণিত : ‘আমি নবী কারীম (সা.) এর সাথে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের সালাত শেষ করলেন, বললেন : আমরা এখন খুতবা দেব। যার ভালো লাগে সে যেন বসে, আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে।’ [সুনান আবু দাউদ : ১১৫৭]খুতবার শেষে অন্যান্য সকলের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা ঈদের অপর একটি সুন্নত। জুবায়ের ইবনে নুফায়ের থেকে বর্ণিত,আল্লাহর রাসূলের সাহাবীরা ঈদের নামাজের পর পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন এবং শুভেচ্ছা বিনিময়কালে তারা একে অপরকে বলতেন,“তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম।” অর্থাৎ আল্লাহ আমার ও আপনার থেকে (নেক আমলসমূহ) কবুল করুন। (ফাতহুল বারী)আলী (র.) থেকে বর্ণিত : ‘সুন্নাত হলো ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।’ [সুনান আত-তিরমিযী : ৫৩৩] উভয় পথের লোকদের সালাম দেওয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য যে পথে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসা।হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘নবী কারীম (সা.) ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন।’ [সহিহ বুখারি : ৯৮৬]অধিক লোকের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করাই উদ্দেশ্য ছিল। তিনি এই বিশেষ দিনে গরিব-দুঃখী মানুষের খোজ-খবর নিতেন। সকলের সাথে কুশলাদি বিনিময় করতেন। ঈদের সময় বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহু (স.) বলেছেন, ‘যে আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে।’ [সহিহ বুখারি : ৬১৩৮]জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারো কারো সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মনোমালিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে তার ভাইকে তিনদিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে দেখা সাক্ষাৎ হলে একজন অন্য জনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ওই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে প্রথম সালাম দেয়।’ [সহিহ মুসলিম : ৬৬৯৭]উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (র.) বর্ণনা করেন : ‘রাসুলুল্লাহ (স.) ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দুটি ছোট মেয়ে গান গাইতেছিল, বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না।ইতোমধ্যে আবু বকর (র.) ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির ঘরে শয়তানের বাঁশি?রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও হে আবু বকর! ঈ্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন।’ [সহিহ বুখারি : ৯৫২]
[caption id="attachment_8156" align="aligncenter" width="1060"] ইসলাম[/caption]
মুসলমানরা প্রথম ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়ে দ্বিতীয় হিজরি মোতাবেক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ বা ৩১ মার্চ। তখনকার ঈদে বর্তমান ঈদের মতো নতুন জামা-কাপড়, কেনাকাটার ধুমধাম ছিল না। তবে আনন্দ-খুশি কম ছিল না। মহানবী (সা.) ঈদের দিন ছোট-বড় সবার আনন্দের প্রতি খেয়াল করতেন। মদিনার ছোট ছোট শিশু-কিশোরের সঙ্গে বিশ্বনবী (সা.) আনন্দ করতেন। শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত সব আনন্দ করার অনুমতি দিতেন। বালিকা বয়সী আয়েশা (রা.)-এর মনের বাসনাও রাসুল (সা.) পূরণ করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, একদা ঈদের দিন আবিসিনিয়ার কিছু লোক লাঠি নিয়ে খেলা করছে। মহানবী (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করেন, হে আয়েশা! তুমি কি লাঠিখেলা দেখতে চাও? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি তখন আমাকে তাঁর পেছনে দাঁড় করান, আমি আমার গাল তাঁর গালের ওপর রেখে লাঠিখেলা দেখতে লাগলাম। তিনি তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন, হে বনি আরফেদা! লাঠি শক্ত করে ধরো। আমি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। তিনি তখন বলেন, তোমার দেখা হয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বলেন, তাহলে এবার যাও।নবীজির হুজরার সন্নিকটে আরেকটি স্পটে ঈদ উপলক্ষে আরেকটি অনুষ্ঠান শুরু হল। কতগুলো বালক নবীর শানে উচ্চাঙ্গের ও মানসম্পন্ন কবিতা আবৃতি করতে লাগল।আয়েশা (রা.) বলেন: নবী করীম (সা.) বসা ছিলেন, ইত্যবসরে আমরা বাচ্চাদের চেচামেচি শুনতে পেলাম।
রাসূল (সা.) উঠে দেখলেন হাবশিরা খেলা-ধুলা করছে আর ছোট ছোট শিশুরা তাদের চারদিকে হৈ চৈ করছে। তিনি বললেন : আয়েশা এদিকে এসে দেখে যাও। অতঃপর আমি এসে আমার থুতনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গর্দানের উপর রেখে তার পিছনে থেকে তাকাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন: তুমি পরিতৃপ্ত হওনি? তুমি কী এখনও পরিতৃপ্ত হওনি? আমি তখন তার নিকট আমার অবস্থান পরীক্ষা করার জন্য বলতেছিলাম না এখনও হয়নি। হঠাৎ ওমর (রা.) এর আগমন ঘটল। সাথে সাথে লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করলেন: আমি দেখলাম জিন ও মানুষ শয়তানগুলো ওমরকে দেখে পালিয়ে গেল। (তিরমিজি)ওরা যে কবিতাগুলো আবৃতি করছিল সেগুলো অর্থ বুঝা যাচ্ছিলনা, কেননা সেগুলো ছিল তাদের নিজস্ব ভাষায়। তাই নবী করীম (সা.) তাদেরকে কবিতাগুলোর অর্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। মুসনাদ ও সহীহ ইবনে হিব্বানে আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, হাবশিরা রাসূল (সা.)এর নিকট এমন কিছু পাঠ করতেছিল যা তিনি বুঝতেছিলেন না। রাসূল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কী বলছে?সাহাবাগণবললেন, ওরা বলছে : মুহাম্মদ সৎ ও নেককার বান্দা।একদা ঈদের দিন মহানবী (সা.) রাস্তার পাশে একটি ছেলেকে কাঁদতে দেখে তার কাছে যান। ছেলেটি বলল, তার মা ও বাবা কেউই নেই। মহানবী (সা.) ছেলেটিকে গৃহে এনে বলেন, আমি তোমার পিতা আর আয়েশা তোমার মা, ফাতেমা তোমার বোন আর হাসান-হোসাইন তোমার খেলার সাথি। মহানবী (সা.) এতিম ছেলেটিকে সন্তানের মর্যাদা দান করেন। এভাবে মহানবী (সা.) ঈদের দিন অসহায়দের সহায়তা দান করতেন।
সাহাবায়ে কেরাম সর্বক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ করতেন। তাঁরা এ বাক্যের মাধ্যমে ঈদের দিন শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থাৎ মহান আল্লাহ আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন।সাহাবায়ে কেরাম মাহে রমজানে গুনাহ মাফ হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে বেশি চিন্তিত থাকতেন। তাই আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর ফারুক (রা.) ঈদুল ফিতরের নামাজে ইমামতি করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে বলতে থাকেন, আমার গুনাহ মাফ না হলে আমি ঈদগাহে গিয়ে কিভাবে ইমামতি করতে পারি। তাঁদের ঈদে নতুন জামা, জুতা ও খাওয়াদাওয়ার ধুমধাম ছিল না। তবে আনন্দ কম ছিল না। মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্য লাভ করা, তাঁকে কাছে পাওয়া, তাঁর নির্দেশ পালন করাই ছিল তাঁদের প্রকৃত আনন্দ। ঈদের দিন অনেক দূর থেকে সাহাবায়ে কেরাম ছুটে যেতেন মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য এবং তাঁর পেছনে দুই রাকাত নামাজ পড়ার জন্য।
দামী দামী পোশাক, রঙ্গিন জামা, হরেক রকম সুস্বাদু খাবার আর নানা ধরণের আনন্দ-উৎসবের নামই কি ঈদ? ধনী গরিবকে এক কাতারে নামাজই শুধু নয় তাদের মধ্যে বৈষম্য দূর করা ঈদের অন্যতম উদ্দেশ্য৷ঈদের উদ্দেশ্য কি তা আল্লাহ তা’আলা নিন্মোক্ত আয়াতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন:‘আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্যে তোমরা আল্লাহর মমত্ব-বড়ত্ব প্রকাশ কর এবং তাঁর কৃতজ্ঞ হও।’ (সূরা বাকারাঃ ১৮৫) এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, ঈদের উদ্দেশ্য হল দুটি:১) আল্লাহর বড়ত্ব মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা।২) আল্লাহ যে নেয়ামত দান করেছেন তার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা।ইসলামে ঈদ একটি সুউচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পরিপূর্ণ প্রতীক। যা দেহ ও মনের প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়। মাহে রমজান ও হজের মাসসমূহের ইবাদত বন্দেগির বাহক হিসাবে ঈদের আগমন ঘটে। ঐ সকল মাসের সব কয়টি ইবাদতই রূহের খোরাক যোগায়। এরশাদ হচ্ছে : তুমি বল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত, এ নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ। (সূরা ইউনুস : ৫৮)
ঈদ হলো সমগ্র মুসলিম জাতির আনন্দ। শরীয়ত বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে। সবচেয়ে কাছের মানুষ পিতা-মাতা থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সকলে মিলে আনন্দ উপভোগ করবে। ঈদ হলো আনন্দ, দয়া, ভালোবাসা ও মিল মুহাব্বতের আদান প্রদানের নাম। ইতিহাস স্বাক্ষ্য বহন করে, ঐ সকল মহামানবগণের আনন্দ পরিপূর্ণ হত না যতক্ষণ না তারা তাদের চারি পাশের ফকির ও অভাবী মানুষের প্রয়োজন মেটাতে না পারতেন। তাই তারা গরীব-দুঃখীকে খাবার খাওয়াতেন, তাদের মাঝে পোশাক বিতরণ করতেন এবং তাদের পাশে এসে দাড়াতেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো অমুসলিমদেরকে দাওয়াত দেয়া ও তাদের ইসলামের হাকীকত সম্পর্কে অবগত করানোর জন্য ঈদ একটি বড় ধরণের মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কালামে এর প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে ঐ সকল লোকের সাথে ভাল ব্যবহার করতে ও তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে নিষেধ করেন না যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেয়নি। (সূরা মুমতাহিনাহ : ৮) নবী জীবনের প্রতিটি দিন ও প্রতিটি মূহুর্তই ছিল যেন ঈদের দিন, যারা তার সাথে উঠাবসা ও চলাফেরা করতেন, এবং তাঁর শরীয়তের আলোকরশ্মি দ্বারা আলোকিত হতেন তাদের জন্য। আর এ কারণেই নবী করীম (সা.) এর আশে পাশে সর্বদাই বিভিন্ন বয়সের ও বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজনের ভিড় লেগে থাকত। বৈদেশিক প্রতিনিধি দল, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন, আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা এমনকি নারীরা পর্যন্ত তার নিকট শিক্ষা অর্জন করতে আসত। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অংশ বুঝে নিতেন হেদায়েত ও নেয়ামতের ভান্ডার থেকে। কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য এ নেয়ামতের ধারা অবশ্যই চালু থাকবে। যে ব্যক্তি নবী আদর্শের উপর অটল থাকবে এবং তাঁর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরবে সেই দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হবে।
এরশাদ হচ্ছে : আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন তাদের মাঝে তাদের থেকেই একজন রাসূল প্রেরণের মাধ্যমে, যিনি তাদেরকে আয়াত পাঠ করে শুনান এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন, আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা ইতিপূর্বে প্রকাশ্য ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ছিল। (সূরা আলে ইমরান : ১৬৪)
বাংলাদেশসহ পৃথিবী আজ এক গভীর সঙ্কটে নিপতিত। করোনা ভাইরাসের কারণে জনজীবন স্তভীর হয়ে আছে। সমাজে নিম্মবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের আয়-উপার্জনের পরিধি পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক সীমিত হয়ে আসছে। দারিদ্রতা ও অর্থ সঙ্কটে দেশের অধিকাংশ মানুষের ঈদ অনেকটা নিরস হয়ে যাবে। ইসলামের মৌলিক নির্দেশনার একটি অনবদ্য শাশ্বত বিধান হল যাকাত, উশর ও ফিতরা প্রদান। মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রত্যেক বান্দা যদি যথাযথভাবে এই সময়ে তা আদায় করে তাহলে সমাজের অভাবী মানুষের ঈদের আনন্দ আরো ব্যাপক ও অর্থবহ হতে পারে। ইসলামের এটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। আসুন গরিব প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে সকারের মাঝে আমরা এই বৈশ্বয়িক সঙ্কটে সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়াই। ঈদের আনন্দ সকলের মাঝে ভাগাভাগি করে নেই। আল্লাহ আমাদের তাঁর বিধান ও মহানবীর (সা.) এর আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে শক্তিশালী মুসলিম উম্মাহ গঠনের তাওফিক দান করুন। আমীন।
[caption id="attachment_2327" align="aligncenter" width="850"] মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ[/caption]
মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
পিএইচডি গবেষক
ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ
(আইবিএস)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com