মনোয়ার হোসেন রতন।।
এ দেশের প্রতিটি মানুষ যেন একটি চলমান কবিতা, একটি জীবনঘনিষ্ঠ গল্প এবং একটি স্বপ্নের নাম। তারা পথচলায় যেমন বাঁচার লড়াই করে, তেমনি স্বপ্ন দেখেন—একটি শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ কাঠামোর। যুগে যুগে বঞ্চনার গ্লানি নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষগুলোই আজকের প্রতিরোধ আর প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। এ সময়ের তরুণ প্রজন্ম হয়ে উঠেছে মুক্তি চেতনার অগ্রপথিক। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় অধিকার, মানবতা ও সুস্থ রাষ্ট্রব্যবস্থার জয়গান।
তরুণদের নেতৃত্বে জাতি যেমন স্বপ্ন দেখে, তেমনি তার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন পড়ে একটি মজবুত কাঠামো—যার ভিত্তি গড়ে ওঠে শৃঙ্খলার উপর। শৃঙ্খলা শুধু বাহ্যিক নিয়ম বা আইন নয়, এটি একটি অন্তরজাগতিক বোধ, একটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চেতনা। রাষ্ট্রের ভিতর যত মতবাদই থাকুক না কেন, সবকিছুর উপরে দাঁড়িয়ে থাকে একটি শৃঙ্খলিত সমাজ ব্যবস্থা। কারণ, মতবাদ রাষ্ট্রকে দৃষ্টিভঙ্গি দেয়, কিন্তু শৃঙ্খলা দেয় সেই মতবাদ বাস্তবায়নের শক্ত ভিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসই আমাদের শেখায়, নেতৃত্বের দূরদর্শিতা আর জনতার ঐক্যবদ্ধ চেতনার সাথে শৃঙ্খলা কিভাবে একটি জাতিকে মুক্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আজকের তরুণরা সেই ইতিহাসের ধারক-বাহক। তাঁদের মধ্যে রয়েছে সাহসিকতা, উদ্ভাবনী চিন্তা এবং দেশপ্রেম। কিন্তু এই সমস্ত গুণের কার্যকর প্রয়োগ সম্ভব তখনই, যখন তা শৃঙ্খলার ছায়ায় পরিচালিত হয়।
রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বলতে বোঝানো হয়—সুশাসন, আইনের শাসন, নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং নাগরিক দায়িত্ববোধের সমন্বয়। শাসক যখন নীতিনিষ্ঠ হয়, এবং জনগণ সচেতন ও দায়িত্ববান হয়—তখনই একটি রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে আদর্শ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। শৃঙ্খলা মানেই কড়া নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং এটি এমন একটি কাঠামো যেখানে স্বাধীনতা এবং দায়িত্ব পরস্পরকে সহায়তা করে। যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়, এবং প্রতিটি নাগরিক নিজ অবস্থান থেকে রাষ্ট্রের কল্যাণে অবদান রাখে।
আজ আমাদের সমাজে অনেক তত্ত্ব, গবেষণা এবং তন্ত্র-মন্ত্রের কথা শোনা যায়। উন্নয়নের জন্য বহু নীতিমালা প্রণীত হয়, পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু এসব কিছুই যদি শৃঙ্খলার অভাবে ধসে পড়ে, তবে তার অস্তিত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রাষ্ট্রে আইন প্রয়োগের অভাব, দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় যখন প্রকট হয়ে ওঠে—তখন রাষ্ট্র কাঠামো হুমকির মুখে পড়ে।
শৃঙ্খলা তখনই জন্ম নেয়, যখন মানুষের অন্তরে থাকে বিবেকবোধ। মানুষ নিজে থেকেই দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে, আইন মেনে চলে, অন্যের অধিকারকে সম্মান করে। শুধু বাহ্যিক নিয়মে নয়, বরং অন্তর থেকে আসা এই নৈতিক শৃঙ্খলাই জাতিকে করে উন্নত ও সমৃদ্ধ।
তাই শাসক হোন বা সাধারণ নাগরিক, সকলের উচিত শৃঙ্খলিত আচরণে অভ্যস্ত হওয়া। গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয়, যখন এর সকল স্তর সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়। একটি পরিবার, একটি প্রতিষ্ঠান, এমনকি একটি রাস্তার ট্রাফিক ব্যবস্থা পর্যন্ত শৃঙ্খলা ছাড়া টিকে থাকতে পারে না—সেটিই বৃহত্তর রাষ্ট্র ব্যবস্থারও ভিত্তি।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি টিকে থাকবে হাজার বছর—এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় পূর্বশর্ত হলো শৃঙ্খলা। এটি কেবল একটি নীতিকথা নয়, বরং একটি জীবন্ত বাস্তবতা। জাতিকে একসূত্রে বাঁধার জন্য যেমন ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস দরকার, তেমনি প্রয়োজন সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রব্যবস্থা। শুধু নেতৃত্ব নয়, প্রতিটি নাগরিকের ভেতর থেকে যদি শৃঙ্খলার বোধ জাগ্রত হয়, তাহলে আমাদের রাষ্ট্র একদিন সত্যিকার অর্থে একটি মানবিক, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক রূপ পাবে।
এজন্য আজ আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন—শৃঙ্খলিত শিক্ষা, দায়িত্বশীল নেতৃত্ব এবং বিবেকবান নাগরিক। কারণ যত উন্নয়নই হোক, যত তত্ত্বই তৈরি হোক না কেন, শৃঙ্খলা ব্যতীত কোন রাষ্ট্র বা সমাজই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।