সম্প্রসারণের আনন্দ

মণে মণে মেট্রিক টন: আগামীর খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি
।। কৃষিবিদ বানিন রায়।।
আজ থেকে ঠিক চার বছর আগের কথা, ২০১৯ সালের এপ্রিল-মে মাস। সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলা থেকে বদলি হয়ে আমার দ্বিতীয় কর্মস্থল নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার হিসাবে যোগদান করেছি। ধান ভিত্তিক বারহাট্টার কৃষিতে সবজি, সরিষা আর নতুন নতুন ধানের জাত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করতে শিখছিলাম উপজেলা কৃষি অফিসার জনাব মো. মোহাইমিনুল ইসলাম স্যারের কাছে। জেলা ও অঞ্চল পর্যায়ের সিনিয়র স্যারেরা মাঝে মাঝে বারহাট্টার কার্যক্রম পরিদর্শন করতেন। তখন ময়মনসিংহ অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ছিলেন শ্রদ্ধেয় জনাব মো. আসাদুল্লাহ্ স্যার। উল্লেখ্য, এই পদে যোগদানের পূর্বে স্যার কুমিল্লা জেলার উপপরিচালক হিসাবে বেশ সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তীতে উনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসাবে কর্মকাল শেষ করেন। তো সিনিয়র কর্মকর্তাগণ যখন উপজেলা পরিদর্শনে আসতেন, তখন তাদের কাছ থেকে নতুন নতুন বিষয় শিখতে চেষ্টা করতাম। তেমনি একদিনের ঘটনা, অতিরিক্ত পরিচালক স্যার উপজেলা কৃষি অফিসার স্যারকে জিজ্ঞাসা করলেন, বলোতো আউশ আবাদ বৃদ্ধির জন্য কোন ধরণের জমি নিয়ে কাজ করতে হবে? ইউএও স্যারের সাবলীল উত্তর, মাঝারি উঁচু জমি স্যার। সেদিনই অতিরিক্ত পরিচালক স্যারের কাছে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির হরাইজনটাল এক্সপানশন ও ভার্টিকাল এক্সপানশন এর ধারণা পাই। সিনিয়র স্যারদের এই কথোপোকথন থেকে শিক্ষা নিয়ে আজ পর্যন্ত আমার কর্মস্থলগুলোতে নানা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি।
যারা কৃষির লোক না তাদের জন্য স্পষ্ট করা দরকার ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির এই হরাইজনটাল এক্সপানশন ও ভার্টিকাল এক্সপানশন বিষয়গুলো আসলে কি? হরাইজনটাল এক্সপানশন বিষয়টা বুঝা তুলনামূলক সহজ, যে কোন ফসলের আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা। তার জন্য প্রয়োজন ফসলটির উপযুক্ত নতুন জমি, সেখানকার কৃষি আবহাওয়ার সাথে যুতসই জাত, কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও লেগে থেকে কাজটি বাস্তবায়ন। শুনতে বেশ সহজ মনে হলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একদল কৃষককে কোন একটি নতুন ফসলে অভ্যস্ত করা কতোটা কষ্টসাধ্য তা আমাদের চারপাশের একদল মানুষকে কোন নতুন বিষয় গ্রহণ করিয়ে তাতে অভ্যস্ত করতে চেষ্টা করলে কিছুটা বুঝতে পারবো। আর সে তুলনায় দ্বিতীয় পন্থা, ভার্টিকাল এক্সপানশন তুলনামূলক বড় আঙ্গিকে ও কষ্টসাধ্য কাজ। যেখানে ফসলটির আবাদি জমি বৃদ্ধির সুযোগ নাই, সেখানে একই ফসলের নতুন জাত ও আধুনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে ক্রমহ্রাসমান কৃষি জমি দিয়ে আগামীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে এটিই হবে আমাদের অন্যতম হাতিয়ার। তার জন্য প্রয়োজন বিদ্যমান জাতের থেকে উচ্চ ফলনশীল ও একইসাথে ঐ এলাকার কৃষি আবহাওয়ার সাথে যুতসই জাত নির্বাচন, সকল কৃষকদের মাঝে জাতটির গ্রহণযোগ্যতা তৈরি ও বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে ধীরে ধীরে সকলের হাতে পৌঁছে দেয়া। চাষাবাদের পুরানো ব্যবস্থাপনার বিপরীতে কৃষকদের আধুনিক বিভিন্ন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত করে তোলা ইত্যাদি। উভয় ক্ষেত্রে সবার আগে দরকার, আগ্রহী ও দক্ষ উপসহকারি কৃষি অফিসার। যারা কৃষকদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে সকল বিষয় বাস্তবায়ন করবে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে বুড়িচং উপজেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারের দায়িত্ব গ্রহণ করি। বুড়িচং উপজেলায় কর্মকালীন সময়ে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির এই পদ্ধতি গুলো সহজভাবে উপসহকারি কৃষি অফিসার ও কৃষকদের মাঝে উপস্থাপন করতে একটি ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করি। “ত্রিমাত্রিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি: নতুন ফসল, নতুন জাত ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা”। প্রায় এক বছর সময় লাগে বুড়িচং উপজেলার কৃষির নানা দিক, কৃষি আবহাওয়া, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে। একইসাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, উপসহকারি কৃষি অফিসারদের সমন্বয়ে আমার টিমের সদস্যদের একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে খাপ খায়িয়ে নেয়া। সকলের সম্মিলিত প্রয়াস ও কঠোর পরিশ্রমের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বুড়িচং উপজেলার মৌসুমি পতিত ২১০ হেক্টর নতুন জমিতে আউশ আবাদ বৃদ্ধি পায় ও সরিষা আবাদ আগের বছরের ৬২ হেক্টরের বিপরীতে ১৬৮ হেক্টরে উন্নীত হয়। বিভিন্ন মৌসুমে নতুন নতুন জাত, যেমন- বোরো মৌসুমে ব্রি ধান৭৪, ব্রি ধান৮৮, ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান৯৬, বঙ্গবন্ধু ধান১০০ ও বিনাধান-২৫; আউশ মৌসুমে ব্রি ধান৮২, ব্রি ধান৯৮ ও বিনাধান-২১, রোপা আমন মৌসুমে স্বল্পকালীন জাত হিসাবে ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭৫, বিনাধান-১৭ ও ব্রি ধান৯৫, কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বিশেষ করে আউশ মৌসুমে ব্রি ধান৯৮ ও বোরো মৌসুমে ব্রি ধান৯৬ এর বিস্তার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সঠিক বয়সের চারা রোপন যেমন- আউশ মৌসুমে ২০ দিনের কম বয়সের চারা বা স্বল্পকালীন আমান ধানের ২৫ দিনের কম বয়সের চারা রোপন, বীজতলায় টুংরো রোগ বিস্তার প্রতিরোধে স্প্রে, বিভিন্ন বালাইয়ের আধুনিকতম বালাইনাশক সমৃদ্ধ ব্যবস্থপনা, বীজ সংরক্ষণ ও বিপণন, ডিএপি ও এম্ওপি সারের ব্যবহার বৃদ্ধিসহ কৃষিতাত্তি¦ক ব্যবস্থাপনার নানা দিক কৃষকেরা সচেতনভাবে প্রয়োগ করছেন। পতিত জমি আবাদের আওতায় নিয়ে আসা, তিল চাষ বৃদ্ধি, বারহাট্টার ডাব বেগুন সম্প্রসারণ, প্রান্তীয় কৃষি ক্লিনিকসহ বিষয়ে উপসহকারি কৃষি অফিসাররা কাজ করে যাচ্ছেন। হাল আমলের অন্যতম সফলতার পালক যুক্ত হয়েছে বুড়িচং এর কৃষি যান্ত্রিকীকরণে। রামপুর ও পাহাড়পুর দুটি গ্রামের কৃষকেরা নিজ উদ্যোগে সিডলিং ট্রেতে চারা তৈরি করে আউশ ধান রোপন করছেন রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের সাহায্যে। সারাদেশের কৃষকদের জন্য এটি উৎসাহদায়ক ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
সকল পরিকল্পনা, উদ্বুদ্ধকরণ, মনিটরিং ও বাস্তবায়ন মূলত ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য। কৃষকদের সমাবেশে আমি প্রায়ই বলি, আপনার এক বিঘা জমিতে দুই এক মণ ধান বেশি হলে বা আপনি ঘরের তেলে সারা বছর রান্না করলে হয়তো আপনার দৃষ্টিতে খুব বেশি অর্থনৈতিক সুবিধা আপনার হচ্ছে না। তবে এভাবে মাঠের বা বুড়িচং বা দেশের সকল জমিতে দুই এক মণ ধান বেশি হলে অথবা দেশের বেশির ভাগ জমিতে সরিষা চাষ হলে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন বেড়ে যাবে বা লক্ষ লক্ষ মেট্রিক টন ভোজ্য তেলের আমদানি হ্রাস পাবে। যা আগামীর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে। দেশমাতৃকার কল্যাণে সৃষ্টি ও উৎপাদনের এমন মহৎ কাজের সাথে জড়িত থাকতে পেরে একজন সম্প্রসারণবিদ হিসাবে আমি অনাবিল আনন্দ ও গর্ব অনুভব করি। কাল বুড়িচং উপজেলায় কর্মরত ছিলাম, আজ দেবিদ্বার উপজেলায় তিনটি মাত্রা নিয়ে ছুটছি।
লেখক: উপজেলা কৃষি অফিসার,দেবিদ্বার।