ডিজিটাল যুগে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
মনোয়ার হোসেন রতন।।
বিগত দশকে বিশ্বব্যবস্থার দ্রুত রূপান্তর, প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির জটিলতায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ এক নতুন বাস্তবতায় উপনীত হয়েছে। এই বাস্তবতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো—কিভাবে রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, বিশেষ করে ডিজিটাল যুগে, যেখানে যুদ্ধের রূপ এখন অনেকাংশেই অদৃশ্য এবং তথ্য-নির্ভর। সামরিক আগ্রাসনের বদলে এখন সাইবার হুমকি, তথ্যযুদ্ধ এবং মতাদর্শিক অনুপ্রবেশ জাতীয় নিরাপত্তার মৌলিক স্তম্ভগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছে।
সার্বভৌমত্বের নতুন সংজ্ঞা: তথ্য-নির্ভরতা ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণঃ
একটি সময় সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা সীমাবদ্ধ ছিল ভূখণ্ড ও সীমান্তরক্ষার মধ্যে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এটি বিস্তৃত হয়েছে তথ্য, সাইবার স্পেস এবং জাতীয় বর্ণনার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আজকে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে ডেটা কুক্ষিগতকরণ, বিদেশি মিডিয়ার প্রভাব, এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তিকর তথ্য।
ইউভাল নোয়া হারারি, তাঁর আলোচিত গ্রন্থ 21 Lessons for the 21st Century-এ বলেন, “যে দেশ তার তথ্য নিজ হাতে রাখতে পারবে, ভবিষ্যতে সেই দেশই স্বাধীন থাকবে।” বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই মন্তব্য গভীর তাৎপর্যপূর্ণ, যেখানে কোটি মানুষ প্রতিদিন বিদেশি মালিকানাধীন প্ল্যাটফর্মে মত প্রকাশ করছে এবং সেইসব তথ্য আমাদের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ডিজিটাল উপনিবেশবাদ: আধুনিক দাসত্বের নতুন রূপঃ
বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন তত্ত্ব জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে—ডিজিটাল কলোনিয়ালিজম, অর্থাৎ ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে বড় টেক কোম্পানিগুলো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের ওপর একধরনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। বাংলাদেশে এই প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। আমরা নাগরিকেরা প্রতিনিয়ত তথ্য তৈরি করছি, কিন্তু সেই তথ্য সংরক্ষিত হচ্ছে বিদেশি সার্ভারে, ব্যবহৃত হচ্ছে তাদের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।
২০২০ সালে সরকার “ডেটা লোকালাইজেশন আইন” প্রণয়নের প্রস্তাব দিলেও তা আজও কার্যকর হয়নি। এর ফলে দেশের জনগণের তথ্য রাষ্ট্রের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে না থাকায় এটি একটি বড় জাতীয় নিরাপত্তার শূন্যতা সৃষ্টি করছে।
আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি ও কৌশলগত ভারসাম্যঃ
বাংলাদেশ আজ এমন একটি ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র—এই ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে আমাদের রাষ্ট্রকে সতর্ক ও কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হচ্ছে।
চীন বাংলাদেশের অন্যতম বড় বিনিয়োগকারী, ভারত আমাদের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী এবং ঐতিহাসিক অংশীদার, আর যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে বলয়ের মধ্যে রাখতে চায়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন একটি স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক অবস্থান, যাতে সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন না হয় এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নিশ্চিত হয়।
ভেতরের হুমকি: মতাদর্শিক বিভাজন ও ডিজিটাল গুজবঃ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে দেখা গেছে, কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা, ভাঙচুর ও অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে। এই ধরণের কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য যেমন বিপজ্জনক, তেমনি সার্বভৌম ক্ষমতার ওপরও হুমকি। কারণ, একটি রাষ্ট্র যদি মিথ্যা তথ্যের স্রোত থেকে তার নাগরিকদের রক্ষা করতে না পারে, তাহলে তার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে দেশে প্রায় ১,২০০টির বেশি গুজব ছড়ানো হয়, যার ৭০ শতাংশই ছড়ানো হয়েছিল বিদেশি পরিচালিত Bot Network ব্যবহার করে। এটি কেবল আইন-শৃঙ্খলার বিষয় নয়, এটি একটি নরম অথচ মারাত্মক সাইবার আগ্রাসন।
রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা নীতিতে রূপান্তর ও প্রযুক্তির সংযোজন প্রয়োজনঃ
বর্তমানে আমাদের প্রতিরক্ষা কাঠামো প্রধানত সামরিক-ভিত্তিক। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এটি যথেষ্ট নয়। সাইবার, কূটনৈতিক, এবং তথ্যনির্ভর প্রতিরক্ষা কৌশল সংযোজন সময়ের দাবি। কিছু প্রস্তাবযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে:
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার একমাত্র বাহন সেনাবাহিনী নয়; সচেতন ও প্রযুক্তি-সচেতন নাগরিকবাহিনী গড়ে তোলাও জরুরি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এখনই ডিজিটাল নিরাপত্তা, তথ্য বিশ্লেষণ ও গুজব শনাক্তকরণ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গণমাধ্যম, একাডেমিয়া ও প্রযুক্তি সংস্থা—তিনটি স্তরের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সচেতন সমাজ গড়ে তুলতে হবে।
একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতায় সার্বভৌমত্ব কেবল ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং এটি একটি বহুমাত্রিক নীতিনির্ভর প্রতিরক্ষা বাস্তবতা। বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন এমন একটি আধুনিক, প্রযুক্তিসমৃদ্ধ, তথ্যনির্ভর কৌশল—যা কেবল বিদেশি হুমকি নয়, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার প্রতিও জবাব দিতে সক্ষম হবে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ তখনই সত্যিকারের স্বাধীন ও নিরাপদ থাকবে, যখন আমরা রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে তথ্য ও প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করে সার্বভৌমত্বকে একটি জীবন্ত, কার্যকর শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।
তথ্যসূত্র
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com