সুবিধা বঞ্চিত নগরীতে বাধ্য হয়ে থাকা!

জেলা যাদুঘর স্থাপন
নারীদের জন্য হাঁটার স্থান
শিশু-কিশোরদের সাইকেল চালানোর সুযোগ
উন্মুক্ত লাইব্রেরি
প্রবীণ কেন্দ্র স্থাপন

inside post

 ।। মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী।

 

“স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমুতে দেয় না”- এ. পি. জে আব্দুল কালাম।
স্বপ্ন নিয়ে ওপরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল প্রচারিত উক্তিটিতে আমি খুব দৃঢ়ভাবে সহমত জানিয়ে বলতে চাই, আমার মতো মানুষ-যাদের বাস্তবায়নের সক্ষমতা খুবই কম তারা যদি তাদের দেখা বাস্তবায়নযোগ্য স্বপ্নের কথা অন্যদের কাছে তুলে ধরে প্রেরণা জাগাতে সক্ষম হয় সেটাও কিন্তু স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে। কেউ স্বপ্ন দেখবে, কেউ স্বপ্নের কথা অন্যেরা জানাবে, কেউ কেউ স্বপ্ন পূরণে কার্যক্রম গ্রহণ করবে এবং কেউ কেউ সেই স্বপ্নের সুফল ভোগ করবে। এভাবে বিনি সুতোর মালা গেঁথে সমাজ, নগর ও দেশ এগিয়ে যাবে।
প্রাণের শহর কুমিল্লা মহানগরের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের পাশে অবস্থিত এ শহর পুরো দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ শহরের একজন বাসিন্দা/নাগরিক হিসেবে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। জন্মের পর প্রায় ২৯ বছর কেটেছে এ শহরের ধুূলোমাটি গায়ে মেখে। পরবর্তীতে কর্মসূত্রে কুমিল্লার বাইরে থাকলেও সুযোগ পেলেই সপ্তাহান্তে ছুটে গেছি এ শহরে। দেখেছি দিনে দিনে এ শহরের নিজের রূপ কিভাবে পাল্টে গেছে। শহরটার আয়তন কিছু বেড়েছে ঠিকই কিন্তু বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার ভারে, বর্ধিত জনসংখ্যার কাঙ্খিত সুবিধাদি নিশ্চিত করতে গিয়ে শহরটা তার শ্রী হারিয়ে দিনে দিনে একজন মানুষের বৃদ্ধ বয়সের চামড়ার ভাঁজের মতো বুড়িয়ে গেছে। খসখসে হয়ে পড়েছে এর বুক। বিশ্বের অনেক শহর যখন স্মার্ট সিটি ধারণা নিয়ে কাজ করছে, সেখানে আমরা যেনতেন ভাবে শহরটা বাড়তে দিয়েছি এবং এখনও দিচ্ছি। পৈত্রিক সূত্রে আমার অবস্থান কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র সবচেয়ে বড় কাঁচা বাজার রাজগঞ্জের পাশে ১১ নং ওয়ার্ডে। একজন শহুরে বসবাসকারীর ন্যূনতম সুবিধা থেকে বঞ্চিত এ এলাকাটিতে আমরা মূলত: বাধ্য হয়ে থাকি। যেটা হয়ে গেছে সেটি নিয়ে কথা বলে কোন লাভ হবে না বলে ধরে নিয়ে এখনও যা আছে তার মাঝেই কিছু ভালো উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমার মতো একজন সাধারণ নাগরিকের কিছু চাওয়া যথাযথ কর্তৃপক্ষের (যদি তাদের নজরে আসে) নিকট তুলে ধরছি:-
০১। একটি জেলা যাদুঘর স্থাপনঃ
যাদুঘরের গুরুত্ব এই সময়ে এসে আর আলাদা ভাবে তুলে ধরার প্রয়োজনীয় আছে বলে মনে হয় না। এক বাক্যে ‘যাদুঘর’ মানুষের কাছে অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধন হিসেবে ভূমিকা রেখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সংযোগ স্থাপনের কাজটি করে। যাদুঘর বিভিন্ন সময়কালের ইতিহাস, শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং অন্যান্য অনেক কিছুর ধারক, বাহক ও প্রদর্শক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। দুঃখজনক হলেও কুমিল্লা মহানগরে এমন একটি জেলা ‘যাদুঘর’ এখন অবধি স্থাপিত হয়নি। কুমিল্লার ১৪ কি:মি: অদুরে ‘ময়নামতি যাদুঘর’ স্থাপন করা হলেও একটি ‘জেলা যাদুঘর’ স্থাপনের গণ উদ্যোগ গ্রহণ করা বেশ জরুরি।

২। মহিলাদের স্বাস্থ্য সচেতনার সুযোগ তৈরি করাঃ
অন্যান্য শহরের মতো কুমিল্লা মহানগরেও সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা। জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে সাথে নিজেকে সুস্থ্য রাখার বা সুস্থতা ধরে রাখার লক্ষ্যে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ছে। প্রতিদিন সকালে-বিকালে অনেক পুরুষ ও মহিলাদের দল বেঁধে কুমিল্লা পৌর পার্ক, নানুয়াদিঘীর পাড়, কিছু কিছু মাঠের চারদিকে হাঁটতে দেখা যায়। হাঁটার জায়গার অভাবে বেশি বিব্রত বোধ করেন মহিলারা। অনেকে ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও হাঁটা-হাঁটির এ সুযোগটা নিতে পারেন না বা বেশিদিন চালিয়া যেতে পারেন না। হাঁটা-হাটিঁর পাশাপাশি যেটি মহিলাদের জন্য প্রয়োজন হয় তা হলো খানিকক্ষণ বসে জিরিয়ে নেয়া সুবিধা এবং শৌচাগার ব্যবহারের সুবিধা। মহিলাদেও উপযোগী এ দুটি নাগরিক সুবিধার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার অভাব কুমিল্লা নগরে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। এ বিবেচনায় কুমিল্লা শহরের কোন একটি মাঠ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শুধুমাত্র নারীদের জন্য হাঁটার উপযোগী করে (বিশ্রাম নেয়ার ও শৌচাগার ব্যবহারের সুবিধাসহ) গড়ে তোলার বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করি।
৩। শিশু-কিশোরদের সাইকেল চালনা সুযোগ তৈরি করাঃ
শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সাইকেল চালনা, সাতাঁর কাটা জাতীয় শারীরিক কসরত বড় ভূমিকা রাখে। এটি স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি মানসিক আনন্দের খোরাক যোগায়। দল বেঁধে সাইকেল চালানোর মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে যে আন্ত:সম্পর্ক গড়ে উঠে সেটি তাকে নেতৃত্বগুনের অধিকারী করে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। উন্নত বিশ্বের শহরগুলোতে শিশু-কিশোরদের সাইকেল চালনার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখতে দেখা যায়। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে শিশু-কিশোররা শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে স্থুলতা সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। আমাদের প্রিয় কুমিল্লা শহরে ইদানিং শিশু-কিশোরদের কথা বাদ দিলেও বয়স্কদেরও সাইকেল চালিয়ে কোথাও যাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে কুমিল্লা শহরের সার্কিট হাউজ মোড় থেকে ঈদগাহের পৌর পার্ক ও ডিসি অফিসের পাশ দিয়ে ঘুরে আবারও সার্কিট হাউজমুখী রাস্তাটিকে সাপ্তাহিক ছুটির শুক্রবার দিন সকাল ৬:০০টা-১০:০০টা পর্যন্ত শুধুমাত্র শিশু-কিশোরদের সাইকেল চালনা করার জন্য উন্মুক্ত করা যেতে পারে। এ সময়টায় এ রাস্তায় অন্য যানবাহন চালনা বন্ধ রাখা যেতে পারে।
৪। একটি উন্মুক্ত লাইব্রেরি স্থাপনঃ
কুমিল্লা শহরে জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যাও বেড়েছে। বেড়েছে কফি শপ, রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দোকান। কিন্তু বাড়েনি মানুষের বই পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় গ্রন্থাগারের। এমনি এক প্রেক্ষাপটে কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র শিল্পকলা একাডেমির কিংবা প্রেসক্লাবে কাছাকাছি বা অন্য কোথাও একটি উন্মুক্ত লাইব্রেরি করার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। যেখানে সকল বয়সী নাগরিকরা বই পড়ার সুযোগ পাবে। উন্মুক্ত লাইব্রেরি স্থাপনের জায়গাটি ঠিক করে দিয়ে এর ব্যবস্থাপনা, বই সংগ্রহের বিষয়ে পাড়া/মহল্লা ভিত্তিক সংগঠনগুলোকে সংযুক্ত করা যেতে পারে।
৫। একটি প্রবীণ কেন্দ্র স্থাপনঃ
প্রবীণরা আমাদের সমাজে বেশ অবহেলিত। কুমিল্লা মহানগরীতে জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে সথে বাড়ছে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা। বয়সের কারণে প্রবীন মানুষদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে অনেক সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। বিশেষ করে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক সমাজ ব্যবস্থায় প্রবীণদেরকে সঙ্গ দেয়ার, তাদের সাথে কথা বলার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই প্রবীণরা যতটা না শারীরিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে পড়েন তার চেয়ে বেশি অসহায় বোধ করেন মানসিক ভাবে। আমাদের ছোট পরিবারগুলো বয়স্ক মানুষেদের সাথে কথা বললেই এটা আঁচ করা যায়। এ প্রেক্ষিতে আমাদের এই শহরে শুধুমাত্র প্রবীণদের আড্ডা দেয়ার, কথা বলার, পত্রিকা পাঠের সুযোগ করে দেয়ার লক্ষ্যে একটি “প্রবীণ কেন্দ্র” গড়ে তোলার বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। এর উদ্দেশ্য হলো, প্রবীণরা যতদিন বাঁচেন ততদিন যেন একটা আনন্দময় পরিবেশে বাঁচেন, সে ধরণের সুযোগ করে দেয়া।
৬। টাউন হলের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণের উদ্যোগ গ্রহণঃ
কুমিল্লা টাউনহল অনেক ইতিহাসের সঙ্গী। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এটি কুমিল্লাবাসীর শ্বাস নেয়ার একটা বড় জায়গা। কিন্তু ইদানিং জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে অতি ব্যবহারে টাউন হলের খোলা জায়গাটি শ্রী-হীন হয়ে পড়েছে। যত্র তত্র ধূমপান, মূত্র ত্যাগ, ময়লা ফেলার কারণে এ চত্ত্বরটি দিন শেষে আর ব্যবহার উপযোগী থাকে না। একটু সচেতন হলে এ সমস্যাগুলো খুব সহজে সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করি। ধূমপান, মূত্র ত্যাগ ও ময়লা ফেলার নির্ধারিত জায়গার ব্যবস্থা করে দিলে এটি কমে আসবে। তাছাড়া এ চত্বরের নিরাপত্তা রক্ষার্থে অনেক উঁচুতে কয়েকটি ফ্লাড লাইটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
এ তালিকাটা হয়তো আরো বড় করা যায়। তবে তালিকা বড় না করে বরং অল্প অল্প করে কাজ শুরু করা যেতে পারে। উপরের প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নে বড় আকারের বাজেটের প্রয়োজন পরবে না বলে ধারণা করা যায়। এ উদ্যেগগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বেসরকারি খাতকে এর সাথে সংযুক্ত করা গেলে খুব দ্রুত এগুলোর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আমাদের কুমিল্লা শহরের বুকে যে দিঘীগুলো/পুকুরগুলো আছে, খেলার মাঠ, খেলার জায়গা আছে-সেগুলোকে পরিকল্পতি উপয়ে নাগরিকদের আনন্দময় ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তুলতে একটা সিটি মাষ্টার প্ল্যানের কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া এখন সময়ের দাবি। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য কুমিল্লা শহর গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।

 

আরো পড়ুন