সোহরাওয়ার্দীর জনসমুদ্রে জামায়াতের সাত দফা

ঐক্যের বার্তা না কি একক শক্তির ঘোষণা?
মনোয়ার হোসেন রতন।।
একটি মুহূর্ত, একটি পরীক্ষা, একটি বার্তা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত আসে, যেগুলো শুধু ঘটনাপ্রবাহ নয়—সময়ের ব্যারোমিটার হয়ে ওঠে। ১৯ জুলাই ২০২৫, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশ ঠিক তেমনই এক ক্ষণ। এই সমাবেশ ছিল না শুধুই একটি দলের শোডাউন। এটি ছিল এক রাজনৈতিক পুনঃপ্রবেশের ঘোষণা, যেখানে সাত দফা দাবি, লক্ষাধিক মানুষের সমাগম, সংগঠনের প্রশাসনিক দক্ষতা এবং স্লোগানময় পরিবেশ এক নতুন সম্ভাবনা ও প্রশ্নের জন্ম দেয়।
জনসমাগম: পুনঃউত্থানের সংকেত?
ঢাকার প্রতিটি প্রবেশপথ থেকে সকাল থেকে দেখা যায় মানুষের ঢল। ময়মনসিংহ, বগুড়া, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রংপুরসহ দেশের প্রায় সব প্রান্ত থেকে আসা জনতা সমবেত হন একটি অভিন্ন পরিচয়ে—”আমরা পরিবর্তন চাই।” এই সমাবেশে উপস্থিত লোকসংখ্যা নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, এটি সাম্প্রতিক কালের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক জমায়েত। তিন শতাধিক মাইক, LED স্ক্রিন, মেডিকেল ক্যাম্প, নামাজের জায়গা, পৃথক প্রবেশপথসহ সুপরিকল্পিত এই আয়োজন ছিল জামায়াতের সাংগঠনিক দক্ষতার প্রকাশ।
স্লোগানের ভাষা: আদর্শ না কৌশল?
সমাবেশ জুড়ে শোনা যায় চারটি মুখ্য স্লোগান—
- “সৃষ্টি যার, শাসন চাই তার”
- “নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর”
- “বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জিন্দাবাদ”
- আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই,“দাঁড়িপাল্লা”
প্রথম স্লোগানটি রাজনৈতিক কর্তৃত্বের দাবি। দ্বিতীয়টি ধর্মীয় অনুরণন। তৃতীয়টি আত্মপরিচয়। আর শেষটি প্রতীকী শক্তির বহিঃপ্রকাশ। এই চারটি স্লোগান একত্রে জামায়াতের রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থান পুনর্নির্দেশ করে—একটি বিপুল জনগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে, যারা দল-মতের ঊর্ধ্বে গিয়ে পরিবর্তন প্রত্যাশী।
সাত দফা দাবি: বাস্তবতা না বার্গেইনিং?
জামায়াত তাদের এই সমাবেশে ঘোষিত সাত দফা দাবিকে জাতীয় সংলাপের ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এই দাবিগুলো নিছক রাজনৈতিক প্রচারণা নয়, বরং একটি আদর্শিক এবং প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের রূপরেখা।
১. নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি নির্বাচন ব্যবস্থা ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের প্রস্তাব
২. ২০২৪-এর বর্ষা বিপ্লবের তদন্ত—সরকারি জবাবদিহিতা নিশ্চিতের আহ্বান
৩. দলীয় সংকীর্ণতা ত্যাগ করে গণভিত্তিক সংস্কার—একটি বৃহত্তর ঐক্যের বার্তা
৪. PR ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা—প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা
৫. আন্দোলনের শহীদ-আহতদের পুনর্বাসন—রাজনৈতিক সহমর্মিতা প্রকাশ
৬. প্রবাসীদের ভোটাধিকার—ডায়াসপোরা শক্তিকে স্বীকৃতি
৭. ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন—রাজনৈতিক স্মারকচিহ্নকে আইনি রূপ দেওয়ার দাবি
এই সাত দফা একদিকে যেমন একটি সমান্তরাল রাজনৈতিক বিবৃতি, তেমনি অন্যদিকে রাষ্ট্রের বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার প্রতি এক তীব্র প্রশ্ন।
কে ছিল, কে ছিল না: ঐক্যের বাস্তবতা ও রাজনৈতিক দূরত্ব
সমাবেশে বিএনপি বা অন্যান্য বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতি এক বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে: এটি কি সত্যিই জাতীয় ঐক্যের আহ্বান, না কি জামায়াতের একক শক্তিমত্তার প্রদর্শনী?
এই সমাবেশে যদি অন্য বিরোধী দলগুলোও অংশগ্রহণ করতো, তাহলে সেটি হতো এক ব্যতিক্রমধর্মী গণসংহতির চিত্র। কিন্তু এখন এটি মূলত জামায়াতের রাজনৈতিক ভূমিকায় প্রত্যাবর্তনের একক ঘোষণা।
শোক ও প্রতিজ্ঞা: ফরিদপুরের ঘটনার প্রেক্ষিতে সংহতি
এই সমাবেশের পথে ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই নেতার মৃত্যু ও আটজন আহত হওয়া দিনটিকে আরও আবেগময় করে তোলে। মঞ্চ থেকে বক্তারা এ মৃত্যুকে ‘শহীদী মৃত্যু’ বলে অভিহিত করেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন—তাঁদের রক্ত বৃথা যাবে না। এই আবেগনির্ভর বার্তা সমাবেশে আরও প্রাণসঞ্চার করে।
নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ: অন্ধকার থেকে আলো, না কি কৌশলগত আলোর ঝলকানি?
প্রশ্ন উঠছে, জামায়াত কি শুধুই ফিরে আসছে, না কি তারা নতুন এক রূপে পুনরুজ্জীবন ঘটাতে চাইছে?
জামায়াত এক সময় নিষিদ্ধ রাজনীতি, মানবতাবিরোধী অভিযোগ, এবং সামাজিক দ্বিধার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তাদের দাবি হচ্ছে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। তবে তাদের অতীত ইতিহাস, রাজনৈতিক জোট থেকে বিচ্ছিন্নতা, এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার নিরিখে তারা এখনও জনস্বীকৃতির এক পরীক্ষামূলক পর্যায়ে অবস্থান করছে।
ঐক্য আসবে কোথা থেকে—দাবি থেকে না আত্মত্যাগ থেকে?
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই মহাসমাবেশ শুধু একটি দলের ঘোষণা নয়, এটি ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির এক নতুন ব্যাখ্যা। এখানে উচ্চারিত প্রতিটি দাবি, প্রতিটি স্লোগান, প্রতিটি শব্দ যদি সত্যিই জনগণের মনে প্রবেশ করে—তবে জাতীয় ঐক্যের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যদি এটি হয় কেবল রাজনৈতিক প্রচারণার একটি ধাপ, তবে তা হয়তো আরেকটি ব্যর্থ আকাঙ্ক্ষার কণ্ঠস্বর হয়ে রয়ে যাবে।
ঐক্য শুধু কণ্ঠে নয়—ঐক্য আসে আত্মত্যাগ, ন্যায়, অংশগ্রহণ এবংবিশ্বাস যোগ্যতার শিকড় গেঁথে। জামায়াত সে শিকড় তৈরি করতে পারছে কি না, এখন সেটাই দেখার।
