স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক

।। জুবাইদা নূর খান।।
২০২০ সালের মার্চ মাস। মনে হলেই শিউরে উঠি। কী বিভীষিকাময় সময় কাটিয়েছি আমরা! লকডাউনে আবদ্ধ স্বাধীন দেশের প্রতিটি নাগরিক। রাস্তাঘাটে সুনশান নিরবতা। হাট বাজার বন্ধ। হিসেব করে খাবার গ্রহণ। পত্রিকা সরবরাহ বন্ধ। টিভির সামনে বসে মৃত্যুর মিছিলে কতজন শরিক হলো দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তা অবলোকন করা। অ্যাম্বুলেন্সের হর্নের আওয়াজে বুকের রক্ত হিম হয়ে যেতো। প্রকৃতির প্রতিশোধের খেলায় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই জিম্মি। কী কোটিপতি ; কী আশ্রয়হীন পথের ভিখারি। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় আজ আমরা সেই দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।
প্রতিদিন সকালে প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া আমার অনেক বছরের অভ্যাস। স্বাধীন দেশের নাগরিক আমি। এই যে স্বাধীন ভাবে হাঁটি, প্রকৃতি দেখি, জীবন নিয়ে ভাবি — এই অধিকার আমাকে দিয়েছে আমার প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমি। এর স্বর্গীয় স্বাদ– সে তো অতুলনীয়। তবে, এই যে স্বাধীনতা, সে তো এমনি এমনি আসেনি। দিতে হয়েছে লক্ষ প্রাণের বলিদান; শত- সহস্র নারীর সম্ভ্রম ; কত মায়ের সন্তানহারা বুকের আর্তনাদ ; কত স্ত্রীর স্বামী হারা চোখে অশ্রুর বন্যা; কত সন্তানের পিতৃহারা কন্ঠে শোকের মাতম।
আমি স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখিনি। যুদ্ধের বেশ কয়েক বছর পর আমার জন্ম। আমার শ্বাশুড়ির মুখে শুনছিলাম যুদ্ধের নয় মাসের দিনলিপি। ওনাদের গ্রামটি প্রত্যন্ত বিধায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো খুবই খারাপ। সে কারণেই পাক বাহিনী ওনাদের গ্রামে সরাসরি আক্রমণ করেনি। তবে, ওনাদের আত্মীয়- স্বজন যাদের শহরে বসবাস তাদের অনেকেই গ্রামে চলে এসেছিলেন ; বিশেষ করে যাদের ঘরে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে আছে তারা ২৫ মার্চের পর রাতের আঁধারে পালিয়ে গ্রামে আশ্রয় নেন। ঐসময় হাট বাজার ও বন্ধ থকতো। পরিবারের নিয়মিত সদস্যদের পাশাপাশি অতিরিক্ত মানুষ যোগ হওয়াতে খাবারের ক্ষেত্রে সকলকে অনেক কষ্ট করতে হতো। আর প্রতিটি মুহূর্ত তারা আতংকে কাটাতেন। কখন না পাকিরা এসে পড়ে। দূরবর্তী বাজারের পাশের গ্রামগুলোতে পাকবাহিনীর আক্রমণের খবর লোকমুখে প্রায়শই শোনা যেতো। এভাবেই অস্থিরতায় কাটতো প্রতিটি ক্ষণ। যাই হোক,

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে নয় মাস যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হয়। তার পরপরই এক পাকি সৈনিককে নাকি গলায় জুতার মালা পরিয়ে ওনাদের গ্রামের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রামের বউ ঝিরা ঘোমটার আড়াল থেকে তা দেখেন। ঐ পাকিদেরকে অভিসম্পাত দিতে থাকেন।

যুদ্ধ শেষে আশ্রিত আত্মীয়রা যার যার অবস্থানে ফিরে যান। দীর্ঘ নয়টি মাস একসাথে থেকেছেন। সীমিত খাবার ভাগ করে খেয়েছেন। যাওয়ার সময় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে তাদের কান্নাকাটি। মানুষ কাঁদে অতি দুঃখে অথবা অতি সুখে। তাদের ঐসময়ের কান্নাটা ছিলো স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কান্না; মায়ার বাঁধন কেটে চলে যাওয়ার কান্না; অন্যদিকে নতুন পরিচয় প্রাপ্তির কান্নাও বটে। কারণ তারা এখন আর পাকবাহিনীর দাস নয়, বরং স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক।
লেখক:সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ।