‘স-এর আবর্তে ‘শ’-এর ছায়ায় বাংলাদেশ

inside post
মনোয়ার হোসেন রতন।।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে আজ আমরা এক শব্দচক্রে আটকে গেছি—যেখানে দুটি বর্ণ, ‘স’ ও ‘শ’, যেন আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর অসুস্থতাকে প্রতীকী ভাষায় প্রকাশ করে।
‘স’ আমাদের মনে করিয়ে দেয় সংকটের কথা, স্ববিরোধের করাল ছায়া, সুশাসনের নিরব অনুপস্থিতি, স্বার্থপর রাজনৈতিক প্রবণতা ও সামষ্টিক স্থবিরতার স্থায়ী চিত্র।
অন্যদিকে, ‘শ’ যেন দাঁড়িয়ে আছে শাসনের ছদ্মবেশী কাঠামো, শোষণের ধারাবাহিকতা, শৃঙ্খলার নামে শ্বাসরোধ, এবং সন্দেহের বিষবাষ্পের প্রতীক হয়ে।
১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়েছিলাম। আজ ২০২৫-এর মধ্য গগনের প্রাক্কালে সেই যুদ্ধ রূপ নিয়েছে অস্তিত্বের প্রশ্নে। স্বাধীনতার রক্তাক্ত প্রভাতে যেই স্বপ্নের বীজ বপন হয়েছিল—নতুন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার, যেখানে থাকবে গণতন্ত্র, ন্যায়, নিরাপত্তা ও সাম্য—সেই স্বপ্ন আজ যেন নিঃশব্দে মরে যাচ্ছে ক্ষমতার কোলাহলে।
সংবিধান আজ আর নাগরিক অধিকার সুরক্ষার দলিল নয়, বরং সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর হাতে তা রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক সিঁড়িতে। শাসকগোষ্ঠী গণতন্ত্রের মুখোশ পরে কর্তৃত্বের নিঃসঙ্গ শাসন কায়েম করেছে। নির্বাচন একটি নিয়মিত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র; মতপ্রকাশ, বিরোধী কণ্ঠ কিংবা প্রতিরোধের ভাষা—সবই আজ রাজনৈতিক অভিধানে নিষিদ্ধ শব্দের তালিকায়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত এদেশের জন্য ছিল একটি নির্লজ্জ দৃষ্টান্তের সময়। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ‘নির্বাচনের বিকল্প ব্যবস্থা’ নামক এক নতুন শাসন-পদ্ধতি কায়েম করা হয়েছে, যেখানে জনগণের মতামত নয়, বরং ক্ষমতাকেন্দ্রিক হিসাব-নিকাশই নির্ধারণ করেছে রাষ্ট্রের গতিপথ।
শুধু রাজনৈতিক পরিসরেই নয়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ‘স’ ও ‘শ’-এর অন্ধ ছায়া বিস্তৃত। অপসংস্কৃতির ঢেউ গ্রাস করেছে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র, অসহিষ্ণুতা দমন করছে সৃজনশীল প্রকাশ। তথাকথিত ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারে বসানো হয়েছিল সেন্সরের তালা। যেখানে শিল্প-সাহিত্য হতো মুক্তির উন্মোচন, সেখানে ভয়ের, সন্দেহের, এবং আত্মসংকোচনের রাজত্ব চলছিল।
আমরা যে জাতি ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, সেই জাতিই আজ শব্দের স্বাধীনতা হারাতে বসেছি। রাষ্ট্রে শাসককণ্ঠই একমাত্র বৈধ, আর নাগরিক কণ্ঠে কেবল সন্দেহ ও সাবধানতার ছায়া।
যেখানে ছিল স্বপ্নের ‘স’—সাম্য, সুরক্ষা, সুশাসন, সৃজন—সেখানে আজ স্থান নিয়েছে সংকট, স্বেচ্ছাচার, স্বার্থান্ধতা, স্থবিরতা।
যেখানে ছিল শুদ্ধতার ‘শ’—শ্রদ্ধা, শৃঙ্খলা, শহীদদের প্রতি সম্মান—সেখানে এখন শুধু শাসনের ছদ্মবেশ, শোষণের রীতি, এবং শরীর ও চেতনার দাসত্ব।
তবুও আশার প্রদীপ নিভে যায়নি পুরোপুরি। এ আঁধারের মধ্যেও কিছু মানুষ এখনো স্বপ্ন দেখছে। কিছু সৎ সাংবাদিক, নির্ভীক চিন্তক, এবং সমাজ সচেতন নাগরিক উদ্যোগ নিচ্ছেন আলোর পথ খুঁজে পেতে। তাঁরা  বিশ্বাস করেন—এ শব্দচক্রই একদিন হতে পারে মুক্তির কণ্ঠ, যদি আমরা সংকটকে সৃষ্টিতে, আর শোষণকে শুদ্ধতায় রূপান্তরিত করতে পারি।
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে, তা নির্ভর করবে এ শব্দদ্বয়ের নতুন অর্থ খোঁজার উপর। ‘স’ যদি হয় সেবা, সহমর্মিতা, সমতা ও সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণের প্রতীক—
আর ‘শ’ যদি হয় শুদ্ধতা, শান্তি, শৃঙ্খলা ও শোভনের প্রতিফলন—তবে এই দুই অক্ষরই গড়ে তুলতে পারে এক নতুন জাতীয়তাবাদ, এক মানবিক রাষ্ট্রচিন্তা।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছে ভাষার উপর ভিত্তি করে—শব্দ ও বর্ণ এখানে কেবল উচ্চারণ নয়, বরং অস্তিত্বের প্রকাশ। তাই এ শব্দদ্বয়ের পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই শুরু হতে পারে একটি জাতির পুনর্জাগরণ।
আজ সময় এসেছে শব্দের গভীরে তাকানোর, প্রশ্ন রাখার এবং স্বপ্ন খোঁজার।
আমরা যদি শব্দকে শাণিত করি, সত্যকে সাহসের সাথে বলি, তবে একদিন ‘স’ ও ‘শ’-এর এই ছায়াঘেরা দিগন্তও হবে আলোকিত। বাংলাদেশ আবারও হয়ে উঠবে জনগণের, ভালোবাসার, এবং ভবিষ্যতের জন্য গঠিত একটি গণতান্ত্রিক, শুদ্ধ ও স্বপ্নময় রাষ্ট্র।
আরো পড়ুন