মনোয়ার হোসেন রতন।।
ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব ঈদ উল আযহা। কিন্তু এটি কেবল পশু জবাই বা উৎসবের বাহ্যিকতা নয়—এটি একটি আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিপ্লবের প্রতীক, যেখানে মানুষ নিজের ভেতরের পশুত্বকে জবাই করে আত্মশুদ্ধির দিকে অগ্রসর হয়। ঈদ উল আযহার প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত আছে আত্মত্যাগ, সংহতি, মানবিকতা এবং সাম্যের মহামূল্যে।
হিজরি বর্ষপঞ্জির জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পালিত এ ঈদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় নবী ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর মহান আত্মত্যাগের কথা। আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম (আ.) যখন তাঁর প্রিয় সন্তানকে কুরবানি করতে উদ্যত হন, তখন তিনি কেবল এক পিতা হিসেবে নয়, একজন ঈমানদার বান্দা হিসেবে আল্লাহর প্রতি নিখাদ আনুগত্য প্রদর্শন করেন। আর ইসমাইল (আ.) ছিলেন এই আনুগত্যের নিঃশব্দ প্রতিচ্ছবি। এই ঘটনার মাধ্যমে প্রতিটি মুমিন শিখে যায়—আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে কোনো আত্মত্যাগই জীবনকে করে তোলে পরিপূর্ণ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আজকের দিনে আমরা কি সত্যিই এই আদর্শ ধারণ করতে পারছি? কুরবানি এখন অনেকাংশে প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। কে কত বড় ও দামী পশু জবাই করলো—সে আলোচনায় মত্ত থেকেও আমরা ভুলে যাচ্ছি কুরবানির আসল শিক্ষা। অথচ পবিত্র কুরআনেই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “আল্লাহর কাছে পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ, আয়াত ৩৭)।
সুতরাং, ঈদ উল আযহার কুরবানি হলো এক প্রতীকী শিক্ষা—নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, অহংকার ও স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই আত্মিক বিপ্লব তখনই সার্থক হয়, যখন ঈদের আনন্দ পৌঁছে যায় সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে। কুরবানির মাংস বিতরণের ধর্মীয় বিধানও আসলে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যম।
ঈদকে ঘিরে আমাদের প্রতিটি কাজের পেছনে থাকা উচিত একটি মানবিক দর্শন—যেখানে প্রতিটি দরিদ্র পরিবার, অনাথ শিশু ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখেও হাসি ফোটে। এই দায়বদ্ধতা শুধু দান নয়, বরং একটি নৈতিক দায়িত্ব, যা আমাদের সামাজিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে।
একটি পরিবার কুরবানি করলেই তাদের ঈদ সম্পূর্ণ হয় না, যতক্ষণ না প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত শিশু বা অসহায় বৃদ্ধের মুখে একটুখানি হাসি ফোটে। ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে তখনই, যখন আমরা বাহ্যিক আড়ম্বর ভুলে গিয়ে হৃদয়ের পবিত্রতা ও সংবেদনশীলতা নিয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়াই।
আজকের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় ঈদ উল আযহার শিক্ষা আরও তাৎপর্যপূর্ণ। এই উৎসব আমাদের শেখায়—আত্মত্যাগই সত্যিকারের উন্নয়ন, আর সংহতিই স্থায়ী শান্তির পথ। ঈদ যদি কেবল বিত্তবানদের খুশির দিন হয়, তবে তা ইসলামের সাম্যবাদের মর্মবাণীকে অসম্মান করা হয়।
তাই ঈদ হোক আমাদের আত্মার অভ্যুদয়ের দিন, হোক আত্মত্যাগের আনন্দে উজ্জ্বল। আমরা যেন এ উৎসবের মাধ্যমে শুধু পশু নয়—জীবনের অহংকার, লোভ, হিংসা ও ঈর্ষাকেও কুরবানি করতে পারি।
আসুন, ঈদ উল আযহাকে আমরা শুধুই একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবে নয়, বরং একটি মানবিক আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করি—যেখানে প্রতিটি হৃদয়ে থাকে সহানুভূতি, প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে পড়ে ভালোবাসা, আলো ও শান্তির সুবাতাস। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে ঈদের প্রকৃত শিক্ষা উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন।