মুসলিম বিশ্বের আত্মবিক্রয়ের রক্তাক্ত দলিল
মনোয়ার হোসেন রতন ।।
ইতিহাস কখনো ক্ষমা করে না। যাদের কাছে ক্ষমতা ঈমানের চেয়েও বড়, রাজসিংহাসন যাদের কাছে কাবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—তারা ইতিহাসের গর্ভে চিহ্নিত হয়ে থাকেন 'হীরক রাজা-বাদশা' নামে। তারা শাসক বটে, কিন্তু তাদের শাসনের ভিত্তি জনগণ নয়, ওয়াশিংটন আর তেলআবিবের মুচলেকা!
আজকের মুসলিম বিশ্ব যেন এক নীতিহীন মরুভূমি। ৫৭টি স্বাধীন রাষ্ট্র, কোটি কোটি মুসলমান-নেতা, রাজা-বাদশা অথচ আত্মার ভেতর শূন্যতা, নেতৃত্বে ভীরুতা, কণ্ঠে কেবল তোষামোদের ক্যানভাস। এ শাসকগোষ্ঠী মুখে ইসলামের বুলি আওড়ায়, কাজে হয় ইসরায়েলের দালাল, মনে বয়ে চলে সাম্রাজ্যবাদী মোহ।
ইতিহাসের কাঠগড়ায় ধর্মবিক্রেতা নেতা,রাজা-বাদশাহরা। কখনো কি ভেবেছেন—৫৭টি মুসলিম দেশ মিলে কেন একটি অবরুদ্ধ গাজাকেও রক্ষা করতে পারে না? কারণ তারা পরস্পরের প্রতিপক্ষ, তারা বিভক্ত। বিভক্ত মনের ভেতর, বিভক্ত স্বার্থে—বিভক্ত আমেরিকান স্বপ্ন ও ইহুদি কূটকৌশলের নকশায়।
নবী মুহাম্মদ (সা.) যখন কুরাইশদের মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গীরা কষ্ট সহ্য করেও আদর্শে আপস করেননি।
আজকের হীরক রাজারা মূর্তি না হোক, মূর্তির কারিগরদের পায়ে মাথা ঠেকায়।
তারা বলে, 'আমরা ইসলামের পক্ষেই আছি।' কিন্তু বাস্তবে তারা তুলে নেয় ইসরায়েলের অর্থনীতি ও আমেরিকার নিরাপত্তা নীতি।
গাজার কান্না বনাম রিয়াদের করতালি, গাজায় যখন শিশুদের বুক ছিন্নভিন্ন হয় বোমায়, তখন রিয়াদ, কায়রো, দোহা কিংবা আবুধাবিতে বসে হয় 'ইসরায়েল ইনভেস্টমেন্ট সামিট'। হয় 'মিডল ইস্ট বিজনেস ফোরাম', হয় 'আব্রাহাম অ্যাকর্ডস'-এর আলাপচারিতা। হয় না শুধু সেই একটি বাক্য—'থেমে যাও, ইসরায়েল!'
১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে অল্প সময়ের জন্য নেতৃত্ব সাহসী হয়েছিল।
সৌদি বাদশাহ তখন তেল রপ্তানি বন্ধ করেছিলেন। আজকের সৌদি প্রিন্স সেই তেল দিয়েই বানান বিলাসবহুল রাজপ্রাসাদ।
আর গাজার পাশে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তিতে চুমুক দেন শ্যাম্পেনে।
এরা কারা? এরা সেই 'হীরক রাজা-বাদশারা'— যাদের 'গণতন্ত্র' মানে নিজের পুত্রকে উত্তরাধিকার বানানো, যাদের 'উন্নয়ন' মানে আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র কিনে অর্থনীতি ধ্বংস করা।
তাদের কাছে—'জিহাদ' মানে স্রেফ ইতিহাসের জীর্ণ শব্দ, 'ঈমান' মানে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত ওয়াজ মাহফিল। তাদের ফতোয়ায় গাজার প্রতিরোধ আন্দোলন হয় 'সন্ত্রাস', আর শিশু হত্যাকে বলা হয় 'প্রতিরক্ষা অধিকার'।
তারা আসলে আধুনিক ফেরাওনের উত্তরসূরি—শরীর ঢেকে রেখেছে ইসলামি পোশাকে, কিন্তু অন্তরজগৎ বিক্রি করে দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদের বাজারে।
আত্মসমর্পণের রাজনীতি: এক চিরস্থায়ী অপমান। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর, বাহরাইন, মরক্কো—এই রাষ্ট্রগুলোর তথাকথিত 'আব্রাহাম চুক্তি' আসলে মুসলিম চেতনার আত্মসমর্পণপত্র। ইসরায়েলের সঙ্গে 'শান্তি'র নামে তারা যে বন্ধুত্ব করেছে, তা নয় শুধু কূটনৈতিক—তা এক চিরস্থায়ী অপমানের দলিল। তাদের কূটনীতি মানে হলো, মোসাদ ও সিআইএ'র সাথে গোপন বোঝাপড়া, ইসরায়েলের প্রযুক্তি আমদানি,
ফিলিস্তিনকে ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা।
তারা চায় এমন এক মুসলিম প্রজন্ম— যে ঈমান নিয়ে জন্মাবে, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলবে না। তারা চায়: এমন সাংবাদিক, যিনি লিখবেন শুধু রাজপরিবারের বন্দনা; এমন ওলামা, যিনি কাবার কসম খাবেন কিন্তু জুলুমের বিরুদ্ধে নীরব থাকবেন। তারা এক ভয়ংকর বেলুন—বাইরে জ্বলজ্বলে আলো, ভেতরে শুধুই ফাঁপা শব্দহীনতা। তারা এমন এক সমাজ গড়তে উদগ্রীব, যেখানে মানুষ কাবা ঘুরবে, কিন্তু কাবার শিক্ষা ভুলে যাবে।
আজ কেউ যদি প্রতিরোধের কথা বলে, তাকে বলা হয় সন্ত্রাসী। ইরান, হিজবুল্লাহ, হামাস, হুথি—যারা অস্ত্র নয়, আত্মমর্যাদা তুলে ধরে—তাদের বিরুদ্ধেই চলে সবচেয়ে বেশি ষড়যন্ত্র। অথচ তারাই আজকের দিনে হযরত ওমর, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ও আল-কাসিমের উত্তরাধিকার। ফিলিস্তিন জ্বলছে, ফিলিস্তিন রক্তে স্নান করছে।
আর আমরা? আমরা এখনো গাই—'হীরক রাজা বুদ্ধিমান, করো সবে তারই জয়গান!'
কিন্তু আমাদের সন্তানরা একদিন প্রশ্ন করবে
'তোমরা কী করেছিলে, যখন মুসলিম উম্মাহকে কফিনে পুরে দেওয়া হচ্ছিল?
সেদিন হীরক রাজা-বাদশারা হয়তো আর ক্যামেরার সামনে থাকবে না। সেদিন ইতিহাস হবে সাক্ষী। তাদের প্রতিটি চুক্তি, প্রতিটি চুপ থাকা, প্রতিটি দালালি হয়ে উঠবে আত্মবিক্রয়ের রক্তাক্ত দলিল।
এখনই সময় বিপ্লবের, ঐক্যের, জবাবদিহির। নইলে আমাদের চুপ থাকাটাই ইতিহাসের কাছে সবচেয়ে বড় অপরাধ হয়ে থাকবে।