মনোয়ার হোসেন রতন।।
আমাদের শিক্ষাজীবনে এমন কিছু মানুষ থাকেন, যারা শুধু শিক্ষক নন—হৃদয়ের পাঠশালার স্থপতি। জনাব সাখাওয়াত হোসেন মজনু ভাই ছিলেন তেমনই একজন, যার হাতে আমরা পেয়েছিলাম শিক্ষা নয়, জ্ঞান; মুখস্থ নয়, হৃদয়স্থ ইতিহাস। তিনি ছিলেন আমার বড় ভাই, আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক, এবং এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও প্রান্তিক ইতিহাসের অন্যতম মৌলিক গবেষক। তাঁর প্রয়াণ ২০২১ সালের পহেলা মে, আঠারো রমজান, আমাদের হৃদয়-আকাশে একটি শূন্যতার সূর্যাস্ত।
তিনি ছিলেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের স্নেহধন্য, বন্ধুপ্রতিম—যিনি বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান। এ দু’জন মানুষের বন্ধন শুধু পেশাগত ছিল না, ছিল চিন্তা, দর্শন ও মানবিকতায় দৃঢ়ভাবে যুক্ত। একটি স্থিরচিত্র আজও সেই বন্ধনকে জীবন্ত করে—যেখানে ড. ইউনুস বসে আছেন, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মজনু ভাই, আর আমরা যেন যুগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এক মহান মুহূর্তে।
মজনু ভাইয়ের হাতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীরা আজ ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে, বিশ্বজুড়ে—যেন তাঁর পাঠশালার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
আমাদের সময় বইয়ের চেয়ে মুখে মুখে শোনা কথাই ছিল বেশি বিশ্বাসযোগ্য। আমরা ইতিহাস শিখতাম ছড়া দিয়ে, গল্পে, কাহিনিতে। সেই পাঠ ছিল কেবল তথ্যগত নয়, ছিল আবেগময়, প্রাণময়। তাঁর শিক্ষা পদ্ধতিই ছিল ব্যতিক্রম—তিনি বিশ্বাস করতেন, “ইতিহাস মুখস্থ নয়, হৃদয়স্থ করতে হয়।”
একটি উদাহরণ আজও মনে গেঁথে আছে—মোগল সাম্রাজ্যের ছয় সম্রাটের নাম শিখিয়েছিলেন একটি মাত্র লোকজ বাক্যে:
“বাবার হইল আবার জ্বর সারিল ঔষধে।”
বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব—এই একটি বাক্য আমাদের মগজে নয়, হৃদয়ে ইতিহাসের ছাপ এঁকে দিয়েছিল।
এমন আরেকটি উদাহরণ, দেশের ভৌগোলিক চিত্র তুলে ধরার জন্য তিনি দিতেন একটি ছড়া—
“উত্তরে হিমালয় ঠাণ্ডা, দক্ষিণে বঙ্গরস পাঁকা, মাঝখানে গঙ্গা হাসে, বাংলাদেশে প্রাণ বাঁকা।”
চারটি চরণেই একটি শিশুও বুঝে নিত দেশের ভৌগোলিক অবস্থা। এমন ছড়া ও লোককথার মাধ্যমে তিনি ইতিহাসকে করে তুলেছিলেন সাহিত্যের মতো হৃদয়গ্রাহী—যেন মানুষ পড়ছে না, বরং জীবন অনুভব করছে।
মজনু ভাইয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাঁর মানবিকতা ও সহজাত শিক্ষা দান দক্ষতা। তিনি ইতিহাসকে কেবল তারিখের সমাহার হিসেবে দেখতেন না, দেখতেন মানুষের সংগ্রাম, বেদনা ও আশার আলেখ্য হিসেবে। তাঁর লেখায় উঠে আসত মাঠের চাষি, গ্রামীণ নারীর কান্না, ভাষা শহীদদের ত্যাগ, আর অজস্র অবহেলিত অধ্যায়।
তিনি পত্রিকায় টানা কলাম লিখেছেন ৩৬ বছর। লোকঐতিহ্য সংরক্ষণের এক নীরব অথচ বলিষ্ঠ যোদ্ধা ছিলেন তিনি। তাঁর শিক্ষার মূলমন্ত্র ছিল—“শিক্ষা যদি জীবনের সঙ্গে মিশে না যায়, তবে তা কেবল পরীক্ষা পাসের হাতিয়ার হয়ে থাকবে। আর এমন শিক্ষা জাতিকে চেতনাহীন করে তোলে।”
তিনি শিক্ষার্থীদের দিতেন এক অন্যরকম চেতনা—যেখানে পাঠ্যবই ছিল দরজা নয়, জানালা—যেখান দিয়ে ছাত্ররা দেখতো বাস্তবতা, অনুভব করতো ইতিহাসের ব্যথা ও সৌন্দর্য।
আজকের প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষায়, ডিজিটাল বোর্ড আর মোবাইলের স্ক্রিনে আমরা যখন ছাত্রদের মনোযোগ ধরে রাখতে হিমশিম খাই, তখন মজনু ভাইয়ের সেই লোকজ পাঠশালার দিকে ফিরে তাকানো সময়ের দাবি। যেখানে শিক্ষক ছিলেন গাইড নয়, ছিলেন পথপ্রদর্শক।
মজনু ভাই বলতেন, “শিক্ষা এমন হওয়া উচিত, যেন ছাত্র বইয়ের পৃষ্ঠা নয়—জীবনের মানে খোঁজে।” সেই চেতনাই তাঁকে একজন শিক্ষক থেকে শিক্ষকতার দিগন্তে পরিণত করেছিল।
আমরা যখন তাঁকে স্মরণ করি, কেবল একজন মানুষকে স্মরণ করি না—একটি সময়, একটি চিন্তা, একটি শিক্ষাদর্শনকে স্মরণ করি। তাঁর মত শিক্ষকরা ইতিহাসকে শুধু লেখেন না—তাঁরা ইতিহাস গড়েন।
এই লেখা শুধুই স্মরণ নয়, একটি দাবি—আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ফিরে আসুক সেই মানবিকতা, হৃদয়বান শিক্ষক, লোকজ শিক্ষার প্রজ্ঞা। ফিরে আসুক সেই পাঠ, যেখানে ইতিহাস মানে শুধু অতীত নয়, বরং বর্তমানের আয়না এবং ভবিষ্যতের পথরেখা।
জনাব সাখাওয়াত হোসেন মজনুর মতো মানুষেরা একবার আসেন, ইতিহাসে নাম লেখান না—তাঁরা ইতিহাস হয়ে থাকেন। তাঁর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা। তাঁর দেখানো পথই হোক আমাদের আলোকবর্তিকা।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com