হৃদরোগ বাড়াচ্ছে ট্রান্সফ্যাট খাদ্য

ট্রান্সফ্যাট কী

 

বেশির ভাগ ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয় শিল্পপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিজ্জ তেল তৈরির সময় তাতে হাইড্রোজেন যুক্ত হয়। এই আংশিক হাইড্রোজেনযুক্ত উদ্ভিজ্জ তেল, যা স্বাভাবিক কম তাপমাত্রায় শক্ত হয়ে যায়, সেটিই হলো ট্রান্সফ্যাট। এটি খুব বেশি ক্ষতিকর না হলেও খাবার তৈরির সময় উদ্ভিজ্জ তেল পরিবর্তন না করে ভাজার জন্য বারবার ব্যবহার করলে তা বেশি বেশি ট্রান্সফ্যাটে পরিণত হয়, যা শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর।

বিজ্ঞাপন

 

ট্রান্সফ্যাটের কারণেই হৃদরোগের মাত্রা আগের চেয়ে বেশি বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য মতে, বিশ্বের ১৫টি দেশে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু মোট মৃত্যুর দুই-তৃতীয়াংশ। এই তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ট্রান্সফ্যাটজনিত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। প্রতিবছর হৃদরোগে যত মানুষ মারা যায়, তার ৪ দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য দায়ী খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি।

বিজ্ঞাপন

এক সময় মানুষের অপুষ্টি দূর করতে ট্রান্সফ্যাটের আবিষ্কার হলেও, এখন এটাই ঘাতক ব্যাধি হৃদরোগের জন্য দায়ী। বিষয়টি সম্পর্কে না জানার কারণে মানুষ ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড) জাতীয় খাবার খাচ্ছে দেদার। শিল্পজাত প্রায় সব ধরনের খাবারে রয়েছে অতিরিক্ত মাত্রার ট্রান্সফ্যাট। শিল্পজাত খাবার খুবই সুস্বাদু বলে খাবারের তালিকার শীর্ষে এটি। বাংলাদেশে ১৯৯০ দশকের চেয়ে বর্তমানে কয়েকগুণ বেশি বেড়েছে হৃদরোগের রোগী।

 

ট্রান্সফ্যাটে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে 

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর যত মানুষ মারা যায়, তার ৪ দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য সরাসরি দায়ী এই ট্রান্সফ্যাট। সংস্থাটি বাংলাদেশসহ ১১টি দেশকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে খাবার থেকে ট্রান্সফ্যাট কমানোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে সব ধরনের চর্বি বা ফ্যাট, তেল এবং খাবারে মিশ্রিত প্রতি একশ গ্রাম ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ সর্বোচ্চ দুই গ্রামে সীমিত করার পরামর্শ দিয়েছে। নীতিমালা না থাকায় বিশ্বের একশটির বেশি দেশ ট্রান্সফ্যাটের ঝুঁকিতে আছে এবং ওই সব দেশের মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি হারে।

বিজ্ঞাপন

ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও ব্র্যান্ডসমূহের নমুনার ৯২ শতাংশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত দুই শতাংশ মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায়। সংস্থাটির গবেষণায়, প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচওর নমুনায় সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পরিমাণটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি।

 

 

আপনার খাবারে ট্রান্সফ্যাট

নানা রকম বেকারিপণ্য, যেমন: কেক, কুকিজ ট্রান্সফ্যাট–সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে অন্যতম। প্রক্রিয়াজাত বিভিন্ন রকমের খাবার, ফ্রোজেন খাবার এবং নানা ভাজাপোড়া খাবার, ফ্রাইড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইও ট্রান্সফ্যাটের অন্যতম উৎস।

ট্রান্সফ্যাট কীভাবে আপনার ক্ষতি করে

রক্তে যেসব কোলেস্টেরল থাকে, সেগুলোর মধ্যে দুই ধরনের কোলেস্টেরল খুব গুরুত্বপূর্ণ।

  • কম ঘনত্বের কোলেস্টেরলের বা এলডিএল, যা ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল হিসেবে গণ্য। এ ধরনের কোলেস্টেরল হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির দেয়ালে চর্বি জমাট বাঁধতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং রক্তনালিগুলো সরু হয়ে রক্ত চলাচলে বাধাগ্রস্ত করে। তাতে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
  • উচ্চ ঘনত্বের কোলেস্টেরলের বা এইচডিএল, যা ‘ভালো’ কোলেস্টেরল। এই কোলেস্টেরল রক্তের ‘খারাপ’ কোলেস্টেরলকে রক্ত থেকে যকৃতে বয়ে নিয়ে যায় এবং রক্তনালির দেওয়ালে চর্বি জমতে দেয় না।

    বিজ্ঞাপন

ট্রান্সফ্যাট আপনার রক্তে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয় এবং ‘ভালো কোলেস্টেরল কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। এভাবে ট্রান্সফ্যাট রক্তের স্বাভাবিক কোলেস্টেরলের মাত্রায় অস্বাস্থ্যকর প্রভাব ফেলে এবং ট্রান্সফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার হার্ট অ্যাটাক, মস্তিষ্কের স্ট্রোক, রক্তনালির অসুখ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।

 

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, দেশে হৃদরোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। অনেক দেশ তাদের জনগণকে ট্রান্সফ্যাটের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার জন্য অনেক কিছু করছে; কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। সরকারের উচিত, যত দ্রুত সম্ভব প্রক্রিয়াজাত ও শিল্প খাতে উৎপাদিত খাবারে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা নির্দিষ্ট করে দেওয়া। পাশাপাশি টিএফএর স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা। হাইড্রোজেনেটেড অয়েল ট্রান্সফ্যাট স্বাভাবিক অবস্থায় তরল থাকলেও ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রায় যে চর্বি বা তেলজাতীয় পদার্থ জমাটবদ্ধ হয় তাও ট্রান্সফ্যাট। এ ছাড়া উচ্চ তাপমাত্রায় দাহ্য তেল বা চর্বিও ট্রান্সফ্যাটে রূপান্তর হয় এবং হার্টের যে কোনো রোগের জন্য দায়ী।

বিজ্ঞাপন

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত ২০২৩ সালের মধ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সরকার, ভোক্তা সংগঠনগুলোকে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা।

দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে-

১. সকল খাদ্যপণ্যে ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুসরণীয় মাত্রা অনুযায়ী মোট ফ্যাট বা তেলের সর্বোচ্চ ২ শতাংশ নির্ধারণ করা

২. ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস ডালডা/বনস্পতির (পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল) উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা

৩. খাদ্যপণ্যের মোড়কে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ উল্লেখ বাধ্যতামূলক করতে ‘মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালা, ২০১৭’ সংশোধন করা

৪. ট্রান্স ফ্যাটমুক্ত খাদ্যপণ্যের জন্য সুনির্দিষ্ট লোগো প্রণয়ন এবং এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা

৫. খাদ্যপণ্যের মোড়কে ট্রান্সফ্যাট সম্পর্কিত বিভ্রান্তিকর/মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভোক্তাদের প্রতারিত করার সুযোগ বন্ধ করা। এক্ষেত্রে মোড়কজাত খাদ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা

বিজ্ঞাপন

৬. খাদ্যপণ্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা পরিমাপের জন্য আধুনিক ল্যাবরেটরি/যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ করা

৭. খাদ্যপণ্যে ট্র্যান্সফ্যাট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য নিয়মিতভাবে মান যাচাই/পরীক্ষা করা এবং প্রাপ্ত ফলাফল ভোক্তাসাধারণের অবগতির জন্য ওয়েবসাইটে উš§ুক্ত রাখা

৮. ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/ কর্মচারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চালু রাখা

বিজ্ঞাপন

৯. ট্রান্স ফ্যাটের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে ভোক্তাসাধারণকে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম গ্রহণ করা।

 

 

—আমোদ ডেস্ক।।