হেফজতের কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি কাসেমীসহ সাতজন গ্রেপ্তার

এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
 নতুন করে গ্রেপ্তার হয়েছে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি আবদুর রহিম কাসেমীসহ সাতজন। এই নিয়ে গ্রেপ্তারের সংখ্যা হলো ৪১৫  জন।
মঙ্গলবার (৪মে) বিকেল চারটার দিকে জেলা শহরের ভাদুঘর থেকে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য, জেলা কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড় মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ার সাবেক শিক্ষা সচিব মুফতি আবদুর রহিম কাসেমীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগে গত ২৪ ঘন্টায় ক্বওমী ছাত্র ঐক্য পরিষদের সেক্রেটারী এবং জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা বেলাল হোসেনসহ আরো ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. রইছ উদ্দিন জানান, ‘হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকদের চালানো তাণ্ডবের ঘটনা তদন্ত করে আবদুর রহিম কাসেমীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এছাড়া ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চালানো তাণ্ডবেও ছিলো তাঁর সংশ্লিষ্টতা।’
এর আগে হোফাজতের চালানো তাণ্ডবের ঘটনার প্রতিবাদ এবং জড়িতদের বিচার চেয়ে গত ২৩ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগ করেন মুফতা আবদুর রহিম কাসেমী। ওইদিন তিনি সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো লিখিত বক্তব্যে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী হেফাজতে ইসলামের ডাকে যে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তা নজিরবিহীন ও অমানবিক। দেশ ও জনগণের জানমালের ক্ষতি কোনোভাবেই ইসলাম সম্মত হতে পারেনা। যাদের প্ররোচনায় দেশ ও জনগণের জানমালের এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার জন্য তিনি সরকারের কাছে দাবী জানান।
প্রকাশ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে আন্দোলনে নামে হেফাজতে ইসলাম। তাদের আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রামে মাদ্রাসাছাত্র নিহত হবার জেরে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীর দিন বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালায় হেফাজতের কর্মী-সমর্থকেরা। শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানোসহ জ্বালিয়ে দেয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন, নিহত হয় এক যুবক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ওঠে উত্তাল। এরই জেরে ২৮ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহবান করে হেফাজতে ইসলাম। এই হরতালকে ঘিরে চালানো হয় আরও নারকীয়তা। হামলা-ভাঙচুর থেকে বাদ যায়নি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব এমনকি সাংবাদিকরাও।ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন, দেড়শ’ বছরেরও অধিক পুরনো ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা কার্যালয়, আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন, বঙ্গবন্ধু স্কয়ারে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, জেলা পরিষদ কার্যালয়, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর, সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব, পুলিশ সুপার কার্যালয়, সিভিল সার্জন কার্যালয়, মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, সরকারি গণগ্রন্থাগার, জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়, শহর সমাজসেবা প্রকল্পের অফিস, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের অফিস, সার্কিট হাউজ, হাইওয়ে থানা ভবন, ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ক্যাম্পাস, হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কালীবাড়ি,জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের অফিস-বাসভবন, দলের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের বাড়িঘর, আশুগঞ্জ টোলপ্লাজা, সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানাসহ ত্রিশটিরও বেশি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে তাণ্ডব চালায় হামলাকারীরা। পুড়িয়ে দেয়া হয় অসংখ্য গাড়ি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরটিকে কার্যত অচল করে দেয়া হয়। এসব ঘটনায় আথাউড়া রেলওয়ে থানায় একটিসহ এ পর্যন্ত ৫৬ টি মামলা দায়ের এবং গ্রেপ্তার হয়েছে ৪১৫ জন।
পুলিশ জানায়, সোমবার (৩ মে) সকালের পর থেকে মঙ্গলবার বিকেল নাগাদ পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি আবদুর রহিম কাসেমীসহ নতুন করে আরো সাতজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। উল্লেখিত সময়ে গ্রেপ্তার হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ক্বওমী ছাত্র ঐক্য পরিষদের সেক্রেটারী এবং জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা বেলাল হোসেনসহ ছয়জন। পুলিশ জানায় গ্রেপ্তারকৃত মাওলানা বেলাল হোসেন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে গত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশে সরকার উৎখাতের সূদুরপ্রসারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসাসহ আশেপাশের বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষককে নিয়ে চালানো হয় ব্যাপক তাণ্ডবলীলা। এসময় সিনিয়র মুরুব্বীদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে হেফাজতের কর্মী-সমর্থক ও ছাত্র শিক্ষকগণ জেলার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় করে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ।সহিংস ঘটনাসমূহের প্রাপ্ত স্থিরচিত্র এবং ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করেই অভিযুক্তদের সনাক্ত করা হচ্ছে বলে পুলিশ দাবী করছেন। তবে গ্রেপ্তারের নামে বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষকে হয়রনি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ মিলছে। এদিকে ২৬-২৮ মার্চ তাণ্ডবের ঘটনায় এযাবৎ দায়ের হয়েছে ৫৬টি মামলা। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় ৪৯টি, আশুগঞ্জ থানায় চারটি, সরাইল থানায় দুইটি এবং আখাউড়া রেলওয়ে থানায় একটি। পুলিশ বাদী হয়ে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দায়েরকৃত এসব মামলায় আসামী করা হয়েছে ৩৫ সহস্রাধিক মানুষকে। তবে এসবে নামোল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৪১৪ জনের। বাকি সবাই ‘অজ্ঞাতনামা দুস্কৃতিকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় মামলার আরজিতে। এ সকল মামলার বিপরীতে এ পর্যন্ত ৪১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জেলা পুলিশ নিশ্চিত করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান বলেন, পুলিশ ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র দেখেই আসামীদের গ্রেপ্তার করছে। এছাড়াও যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে, যাতে কোনো নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার না হন।’