।। ড.সফিকুল ইসলাম।।
৭১ এর সূচনা হওয়ার পেছনে রয়েছে ২৩ বছরের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের ইতিহাস। ভিন্ন জাতি দ্বারা বাঙালি জাতির প্রতি বৈষম্য। আর ২৪ এর অভ্যূথানের পেছনে রয়েছে আমাদেরই জ্ঞাতি ভাইদের দ্বারা নানান বৈষম্য ও বঞ্চনার ঘটনা। ৭১ এর সূচনার অন্যতম মূল ভিত্তি হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা। ২৪ এর অভ্যূথানের পেছনেও নিশ্চয়ই গণমানুষ তথা তরুণ প্রজন্ম ফুঁসেছিল ভোট দিতে না পারার রাগে ও ক্ষোভে।
তবে ৭১ এর সাথে ২৪ এর তুলনা চলে না। কারণ দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও ভিন্ন বিষয়। তাছাড়া একাত্তরের যে পরিমাণ ক্ষতি তা আসলে তুলনা করা যায় না। লক্ষ লক্ষ মানুষকে গণহত্যা করা, লক্ষ লক্ষ শিশুকে হত্যা করা, লক্ষ নারীদেরকে ধর্ষণ ও হত্যার মাধ্যমে যে অবর্ণণীয় ক্ষতি হয়েছে তার সাথে চব্বিশের তুলনা আসলে চলে না। আর একাত্তর ছিল একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে আগমন করার প্রয়াস, একাত্তর ছিল নতুন একটি পতাকা পাওয়া, নতুন স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশ পাওয়া। সেটার সাথে চব্বিশের তুলনা আসলে কখনোই চলে না। ৭১ এ রক্তের লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে পেয়েছি স্বাধীন দেশ আর ২৪ এ হাজার মানুষের প্রাণের বিনিময়ে পেয়েছি গণতন্ত্রের পথে পুনরায় ফিরে যাওয়ার ভিত্তি।
৭১ এর ভিত্তিসমূহ ও নানান ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক বেশি হলেও চব্বিশের বিষয়টি অন্য কারণে আরও বেশি ব্যথার, বেদনার ও বিদ্রোহ সৃষ্টি হওয়ার মতো। কারণ চব্বিশে আমাদেরই দেশের আমাদেরই মানুষ আমাদের জনতাকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য হত্যা করেছে। এদিক থেকে চব্বিশের ঘটনাটির গুরুত্ব কম নয়, আর ব্যথার তীব্রতা অনেক অনেক বেশি। ১৯৭১ সালের হানাদার পাকিস্তানিরা আমাদের দেশের সম্পদ তাদের দেশে নিয়ে গেছে। ২০২৪ এর হানাদার আমাদেরই বাংলাদেশি, আমাদের দেশের সম্পদ বিভিন্ন দেশে নিয়ে গেছে। কারণ আমাদের দেশই এদের দেশ। ১৯৭১ সালের হানাদার ছিলো ভিনদেশী হানাদার। ২০২৪ এর হানাদার হলো স্বদেশী হানাদার। ১৯৭১ সালের হানাদার ছিলো ভীনদেশি। সেজন্য না হয় আমাদের জনগণের প্রতি তাদের মায়া ছিলো না। কিন্তু ২০২৪ এর হানাদার হলো স্বদেশী। এরা নিজ দেশের জনগণের প্রতি এতটা নির্দয় হলো কেমন করে? ৭১ এর সাথে তুলনা চলে না, তবু তুলনা এসে যায়।
৭১ ও ২৪ পরস্পরবিরোধী নয়, বরং পরিপূরক। কারণ দুটিতেই জনমত ও গণমানুষের ঢেউয়ের জয় হয়েছে। ৭১ এ যেসব গান শুনে শুনে মুক্তিযোদ্ধারা উজ্জীবিত হয়েছে, ২৪শের তরুণেররাও সেসব গান শুনে উজ্জীবিত হয়েছে। ‘নোঙ্গর তোলো তোলো, সময় যে হলো হলো‘, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল‘,‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানগুলো ২৪শেও মানুষকে জাগিয়েছে। তাছাড়া নতুন গান যেমন ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’, ‘কি করেছে তোমার বাবা, কি করেছে স্বামী’ , ‘লড়রে মানুষ লড়রে মানুষ আপন মানুষ দখল করে নিয়েছে ঘর’, ‘কথা ক‘, ‘চলো ভুলে যাই’ গণমানুষের হৃদয়ে ঝড় তুলেছে।
তাছাড়া যদি আমরা শ্লোগানগুলো দেখি তাহলেও ৭১ এর সাথে কিছু সাযুজ্য আমরা পাই। আবাল বৃদ্ধ বণিতা জেগে উঠেছিল এসব শ্লোগান আওড়ে আওড়ে। দেওয়ালে দেওয়ালে গ্রাফিতি দিয়ে দিয়ে । যেমন ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে, লেগেছে রে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে; জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে; ঝড় বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি রাজপথে; দিয়েছিতো রক্ত, আরও দেবো রক্ত; রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়; ১৮র হাতিয়ার গর্জে উঠো আরেকবার; ৭১ এর হাতিয়ার গর্জে উঠো আরেকবার; তুমি সমস্ত ফুলকে ছিঁড়ে ফেললেও বসন্তের আগমনকে ঠেকাতে পারবে না; ৫২ দেখিনি ২৪ দেখেছি; বুকের ভিতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর; আসছে আবার ফাগুন, আমরা হবোই দ্বিগুণ। এরকম আরও কত শত শ্লোগান।
আমি ব্যক্তিগতভাবে যদিও ৭১কে ২৪শের সাথে তুলনা করতে রাজি না। তবু কিছু বিষয় আসলে তুলনা হয়ে যায়। যেমন স্বজন যে হারায় নি বা ক্ষতিগ্রস্ত যে হয় নি, সে যেমন ৭১ বোঝে না, তেমনি স্বজন যে হারায়নি ক্ষতিগ্রস্ত যে হয় নি, সে ২৪ বুঝবে না। ৭১ এ শহীদ রুমির মায়ের মনের যে কষ্ট, আর ২৪শে শহীদ সাইয়ীদ ও মুগ্ধর মায়ের মনের কষ্টের রঙ আলাদা নয়। দুজনের মায়ের মনের কষ্টের ভার অসমান নয়। আমাদের গভীরে তলিয়ে দেখতে হবে যে, কেন রুমি বা সাইয়ীদ বা মুগ্ধ জীবন দিতে বুক পেতে দিয়েছে। কার জন্য, কীসের জন্য?
গণতন্ত্রের জন্য, গণমানুষের কথা বলার অধিকারের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, বাকস্বাধীনতার জন্য গণমানুষ জেগে ওঠে। সময়টা হতে পারে, ৫২, ৭১, ৯০ বা ২৪। সময় ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু মানুষের মনের আকুতিগুলো একই। দুর্ভাগ্য আমাদের বারবার প্রাণ দেওয়ার পরেও আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত জীবনযাত্রা পাই না, আকাক্সিক্ষত দেশ ও সমাজ পাই না। এবার ২৪ পেলাম, এখানেই কি শেষ, নাকি আবার কোনো নতুন সালে নতুন যুদ্ধে নামতে হবে, তা সময়ই বলে দিবে।
বিজয়ীরা ইতিহাস লিখে। লেখার সময় বিজয়ীদের গুণগাঁথা লেখা হয়, আর পরাজিতদের নামে কিছু সত্যের পাশাপাশি অজস্র মিথ্যা বয়ান তৈরি হয়। পরাজিতরা প্রতিবাদ করতে পারে না। করলেও তা ধোপে টিকে না।
৭১-৭৫ পর্যন্ত আমরা একরকম বয়ান দেখেছি। ৭৫-৮০ আরেকরকম বয়ান পেয়েছি। ৮১-৯০ আবার অন্যরকম খেলা। ৯১-২০০৮ ইতিহাসের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। আর তারপরে ১৬ বছর আবার নতুন নির্মাণ ও পুনর্নিমাণের ইতিহাস আমরা পড়েছি, শুনেছি। ২০২৪ পরবর্তী খেলায় আবার আমরা নতুন বয়ানের পথে হাঁটছি।
পথ যতই হোক, সত্যের পথে হাঁটা আমাদের হলো না। যদিও কতিপয় আলোকিত মানুষ এসব বুঝেন, তবু গণমানুষকে নানানভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতির খেলায় ফেলে দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষ এসব শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে গ্রহণ করতে না চাইলেও গ্রহণ হয়ে যায়।
নতুন প্রজন্ম অবশ্য আগের খবর দেখে নি, জানে না। তবে গত ২০ বছরের খেলা দেখেই বুঝতে পারে যে, জানার ও বোঝার শেষ নেই। ইতিহাস লেখার কথা ইতিহাসবিদগণের এবং তাই জনতার পড়ার কথা। কিন্তু না। ইতিহাস নির্মাণ করেন, বিনির্মাণ করেন, প্রচার করেন, বহাল করেন সব রাজনীতিবিদেরা। সুতরাং রাজনৈতিক পালাবদলে ইতিহাসের বিনির্মাণ, পুননির্মাণ ও প্রচার চলমান থাকে। সেকারণে ইতিহাসের গতি পরিবর্তিত হয়, আবার পুনরাবৃত্তিও হয়। সমস্যা হলো মানুষ সব মনে রাখে না। বা রাখতে চায় না।
নতুন প্রজন্মের উচিত সাবধানতার সাথে চিন্তা করা, ঘটনার সাথে ঘটনা, আগের সাথে পরের ঘটনা, এর সাথে স্বার্থ-সংশ্লিষ্টদের খেলা বুঝতে পারা। ইতিহাসের বোঝাপড়া অনেক কঠিন। তাই প্রতিটি ঘটনাকে আলাদা বিশ্লেষণ করতে হবে, আবার তুলনাও করতে হবে। কীভাবে গণমানুষ বারবার ধোঁকা খায়, খেলার শিকার হয়- তা বুঝতে হবে। বিজয়ীদের ঘোড়ায় চড়ে গণমানুষের মনন বোঝা যায় না। চলুন যে ভুল আমাদের আগের নেতৃত্ব করে গিয়েছেন, সে ভুল আমরা আর না করি। আমরা আবার নতুন করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত না হই। কারণ গণমানুষ যত বোকাই হোক, তারা মাথায় যেমন তুলতে পারে, আবার ছুঁড়ে ফেলতেও পারে। ৪৭ থেকে ২৪, প্রতিটি বাঁক থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি।
লেখক: সরকারের উপ-সচিব,সাহিত্যিক।
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com