শিক্ষার্থীরা এখনও শাসনের জন্য পিঠ পেতে দেন
মহিউদ্দিন মোল্লা ।।
মকবুল আহমদ। জন্ম ১৯২৯সালের ২২জুন। বয়স এখন ৯৬এর ঘরে। পেশায় শিক্ষক ছিলেন। প্রায় ৪০বছর। এখনও ভরাট গলা। স্মৃতি শক্তিও অটুট। কবে মেট্রিক পাশ করেন। মাস তারিখসহ বলতে পারেন। বলতে পারেন কোন সালের কোন মাসের কত তারিখ কোন কোন স্কুলে কত বছর, মাস ও দিন চাকরি করেছেন। কুমিল্লা জিলা স্কুলে ২৬ বছর শিক্ষকতা করেন। সেখান থেকে অবসর নেন সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন কুমিল্লা চর্থা লুৎফুন্নেছা হাই স্কুল থেকে। এখন ৬০বছর বয়সী ছাত্ররাও তাকে খুঁজে ফিরেন। দোয়া নেন। পিঠ পেতে দেন মমতার শাসন পেতে। শিক্ষার্থীদের সন্তানের মতো শাসন সোহাগ করায় জিলা স্কুলের নাম এলেই আসে মকবুল স্যারের নাম। অনেকে তাকে টাইগার স্যার বলে ডাকেন।
শুক্রবার বিকালে মকবুল আহমদের সাথে কথা হয় তার নগরীর ঠাকুরপাড়ার বাসায়। বাসার নাম আমজাদ কোর্ট। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার ফতেপুর গ্রামে। বাবা আমজাদ আলী পাটোয়ারী স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ৫ভাই ৫বোনের মধ্যে তিনি ৫ম। তিনি ও দুই বোন বেঁচে আছেন। তার স্ত্রী গৃহিনী। স্ত্রী সুরাইয়া বেগমের সাথে ৬০ বছরের দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করছেন। তাদের ৩ ছেলে ১ মেয়ে। তিনি নিজেকে এখনও ফিট মনে করেন। তিনি আবারও পড়ানোর সক্ষমতা রয়েছে বলেও জানান। খালি চোখে বই পড়েন। লাঠি ছাড়া হাঁটেন। নেই ডায়বেটিসসহ বড় কোন রোগ। এখনও প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর তিনি।
আলাপচারিতায় তিনি বলেন,তার প্রধান পুঁজি শিক্ষার্থীকে জাগিয়ে দেয়া। পড়ার বাইরেও শিক্ষার্থীকে সন্তানের মতো খেয়াল রাখা। শাসন আর সোহাগে বুঝিয়ে পড়ানো। তিনি বলেন,এলাকার স্কুলে মেট্রিক পাশ করেন। চাঁদপুর কলেজে ইন্টারমেডিয়েট। ডিগ্রি পাশ করেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে ১৯৬০সালে। এলাকার বেসরকারি স্কুলে প্রথম শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৬৪সালে চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলে প্রথম তার সরকারি চাকরি হয়। তারপরে জিলা স্কুলে আসেন। মাঝে কিছু দিন কুমিল্লা কোটবাড়ি ল্যাবরেটেরি স্কুলে চাকরি করেন।
তিনি বলেন, সময়ের গুরুত্ব দিয়েছি। সময় মতো স্কুলে গিয়েছি। এনিয়ে হয়তো কখনও বাসায়ও বিরক্তির কারণ হতে হয়েছে। আমি সময় না মানলে শিক্ষার্থীরা কেন মানবেন? বাবার আদেশে শিক্ষকতায় এসেছি। অনেক স্বজন হেসেছেন। বলেছেন-শিক্ষকতা করে ফাটা স্যান্ডেল আর ছেঁড়া জামা পরবে। কিন্তু আমি তৃপ্তির সাথে শিক্ষকতা করেছি। এই দীর্ঘ জীবনে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা নিয়ে আমি পরিতৃপ্ত। আল্লাহর কাছে হাজারো শোকরিয়া। শিক্ষকতা আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছে। এখন অবসরে যাওয়া শিক্ষার্থীরা প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে বাসায় আসে। পায়ে ধরে সালাম করে। পিঠ এগিয়ে দেয়। বলেন- স্যার একটা থাপ্পড় দিয়ে দোয়া করে দেন। আপনার শাসন সোহাগ না পেলে এগিয়ে যেতে পারতাম না। এগুলো শুনলো আনন্দে মনটা ভরে যায়।
বিশেষ করে চিকিৎসক ছাত্ররা ফি না নিয়ে পিঠ এগিয়ে দিয়ে বলেন,একটা থাপ্পড় দেন, সেটাই ফি! ওই দিন এক জেলার ডিসি এসে বলেন- তাকে থাপ্পড় দিতে। ওটাই নাকি তার নিকট দোয়া!
তিনি বলেন,ইংরেজি বিষয় পড়াতাম। ক্লাসের বাইরেও কোন ছাত্রের নামের বানান ভুল হতো কিনা। অভিভাবককে খবর দিয়ে এনে সংশোধন করাতাম। তার দুর্বলতা থাকলেও ধরিয়ে দিতাম। নিজের সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করতাম। আমি সাধারণ মেধার মানুষ। লেখাপড়াও বেশি নিই। শুধু যতœ,সততা আর সময়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছি। সাফল্যে বিষয়ে তিনি বলেন, বাবা-মা‘র দোয়া আমার বড় পুঁজি। বাবা-মা বেঁচে থাকতে প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে গিয়ে দেখে আসতাম। অবসরের বিষয়ে বলেন, এখন গ্রামের শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তদারকি, বাসায় বই-পত্রিকা পড়ে সময় কেটে যায়।
জিলা স্কুলের ছাত্র পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাসুদ রানা চৌধুরী বলেন, স্যারের ছাত্র হিসেব গৌরব বোধ করছি। স্যারের এক ছেলে মোস্তফা জামান আমার সহপাঠী। স্যার সবাইকে তার সন্তানের মত যতœ নিতেন। তার সবার নাম মুখস্ত। ব্যক্তিত্ব, মেধা ও পরিশ্রমে কারণে তিনি সবার প্রিয় হয়ে উঠেছেন। কুমিল্লা জিলা স্কুল ও মকবুল স্যার সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছে। স্যারের দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুল হাফিজ বলেন, মকবুল স্যারকে কলিগ হিসেবে আমি পাইনি। কিন্তু তার সান্নিধ্য পেয়িছি। তিনি চমৎকার মানুষ। তাদের হাত ধরে আমাদের সমাজ আলোকিত হয়েছে। আমি তার সুস্থ জীবন প্রত্যাশা করছি।
(ছবি: সাইফুল ইসলাম সুমন)
মোবাইল: ০১৭১৭-৯১০৭৭৭
ইমেইল: newsamod@gmailcom
www.amodbd.com