পাথর দিয়ে কি হবে, সোনা দিয়ে মোড়াবো এ বাংলা!

মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল ও নদীগুলো একসময় ছিল জীববৈচিত্র্যের স্বর্গভূমি, পর্যটনের গর্ব এবং মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস। কিন্তু আজ সেগুলো পরিণত হয়েছে লোভ, চুরি আর ধ্বংসযজ্ঞের মঞ্চে। সুনামগঞ্জ, জাফলং, সাদা পাথর, তাহিরপুর—যেদিকে তাকানো যায় সেখানেই অবৈধ পাথর ও বালি উত্তোলনের ভয়াবহ চিত্র। কেবল আর্থিক ক্ষতিই নয়—এটি পরিবেশের জন্য নীরব মৃত্যুঘণ্টা।
লুটের প্রমাণিত ঘটনাঃ
- সুনামগঞ্জ (ধোপাজান–ছালতি নদী): চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে; আনুমানিক ক্ষতি প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
- জাফলং ও সাদা পাথর: এক সপ্তাহে প্রায় ২০০ কোটি টাকার পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন; পরিবেশ আইনবিদ সংস্থা বেলা (BELA) সরকারের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে।
- পিয়াইন ও গোয়াইন নদী: ১ কোটি ঘনফুট পাথর লুট—বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
- তাহিরপুর (জাদুকাটা নদী): ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৬ জন চোরাকারবারি গ্রেপ্তার ও কারাদণ্ড।
- পাটগ্রাম নদী: রাতভর অবৈধ পাথর উত্তোলন, ৫০টি ড্রেজার ধ্বংস হলেও কার্যক্রম বন্ধ হয়নি; রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ।
এ তথ্যগুলো স্পষ্ট করে যে, শুধু স্থানীয় চোরাকারবারি নয়—পুলিশ ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও সিন্ডিকেটের অংশ।
প্রকৃতি ধ্বংসের ভয়াবহ প্রভাবঃ
অবৈধ যান্ত্রিক পাথর উত্তোলন নদীর গতিপথ নষ্ট করছে, নদী ভাঙন বাড়াচ্ছে, পাহাড় ধসে পড়ছে, ভূগর্ভস্থ পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে। ২০০৫ থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ১১৭ জন শ্রমিক নিহত ও ৫৩ জন আহত হয়েছেন—বেশিরভাগই পাহাড়ধস ও ড্রেজারের দুর্ঘটনায়। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) সতর্ক করেছে—এই ধরণের অতিরিক্ত উত্তোলন মাটির ক্ষয়, প্রাকৃতিক ঝড়-বন্যার ধারা পরিবর্তন, ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ঘটাচ্ছে। নদী ও পাহাড়ের ভারসাম্য নষ্ট হলে শুধু পরিবেশ নয়—স্থানীয় কৃষি, মৎস্য, এমনকি পর্যটন শিল্পও ধ্বংস হবে।
রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও প্রশাসনিক ব্যর্থতাঃ
রাতভর সিন্ডিকেট নদী থেকে পাথর তুলছে—এ যেন প্রকাশ্য গোপন ব্যবসা। প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে কিছু ড্রেজার ধ্বংস করলেও, রাজনৈতিক প্রভাব ও লাভের ভাগাভাগির কারণে এসব উদ্যোগ স্থায়ী হয় না। আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ দুর্বল। মামলা হয়, কিন্তু বিচার শেষ হয় না। অপরাধীরা আবার ফিরে আসে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি মানেই উন্নয়নের ক্ষতিঃ
এক বছরে অবৈধ পাথর-বালি ব্যবসা থেকে হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে গেলে স্কুল, হাসপাতাল, সেতু ও অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব হতো। পরিবর্তে, কিছু প্রভাবশালী ও অপরাধী চক্র সেই টাকা বিদেশে পাচার করছে অথবা কালো বাজারে বিনিয়োগ করছে। অর্থাৎ—এটি শুধু অপরাধ নয়, উন্নয়ন ও জনগণের অধিকার হরণের সমান।
সমাধানের পথ আছেঃ
- প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি: নদী ও উত্তোলন এলাকা সিসিটিভি, স্যাটেলাইট ইমেজিং ও জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের আওতায় আনতে হবে।
- দ্রুত বিচার: অপরাধী যেই হোক, দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
- জনসম্পৃক্ততা: স্থানীয় জনগণকে প্রকৃতি রক্ষায় যুক্ত করতে হবে; অভিযোগ জানানোর নিরাপদ ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- বিকল্প কর্মসংস্থান: শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ, আইনসিদ্ধ কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
- রাজনৈতিক সদিচ্ছা: সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সত্যিই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আমরা যদি এখনই না জেগে উঠি, তাহলে নদীর বুক শুকিয়ে যাবে, পাহাড় হারিয়ে যাবে, প্রকৃতির প্রাণ ভেঙে যাবে। তখন পাথর দিয়ে অট্টালিকা বানালেও, তা দাঁড়াবে ধ্বংসের বুকে। এ দেশের আসল সোনা—মাটি, পানি, গাছ, পাহাড়—এসব রক্ষা করাই আমাদের প্রকৃত উন্নয়ন। তাই আজ দুঃখের সঙ্গেবলতে হয়—পাথর দিয়ে কি হবে, সোনা দিয়ে মোরাবো এ বাংলা!!! যদি আমরা প্রকৃতি রক্ষা করি, তবে এই দেশ সোনা ফলাবে—শুধু অর্থে নয়, জীবনে, ভালোবাসায়, প্রজন্মের স্বপ্নে।
তথ্যসূত্র:
১. পরিবেশ আইনবিদ সংস্থা (BELA) – স্মারকলিপি, ২০২৫
২. সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন – অবৈধ পাথর উত্তোলন তদন্ত প্রতিবেদন, ২০২৫
৩. UNEP – Environmental Impact of Sand and Stone Extraction, ২০২৪
৪. স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম – দৈনিক সিলেটের ডাক, দৈনিক আমার দেশ, ২০২৫
৫. ভ্রাম্যমাণ আদালতের মামলা নথি – তাহিরপুর উপজেলা, সুনামগঞ্জ, ২০২৫
