গাজা অভিমুখে ‘সুমুদ’ ফ্লোটিনা

মানবতা বনাম অবরোধের বিশ্ব রাজনীতি

মনোয়ার হোসেন রতন ।।

“সুমুদ” — আরবিতে যার অর্থ ‘স্থিতিশীলতা’ বা ‘প্রতিরোধ’। সেই প্রতিরোধের প্রতীক হয়েই এবার আন্তর্জাতিক জলসীমায় গড়ে উঠল ৫০টি জাহাজের বিশাল নৌবহর, যার গন্তব্য ইসরায়েলি অবরোধে বিপর্যস্ত গাজা উপত্যকা। তাদের লক্ষ্য মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া, এবং বিশ্বের চোখে অবরোধের অবৈধতা তুলে ধরা।

এই নৌবহরটির নাম— Global Sumud Flotilla (GSF)। এতে অংশ নিয়েছেন শতাধিক মানবাধিকারকর্মী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, পরিবেশবাদী ও বিশ্বনেতারা। তাদের মধ্যে আছেন সুপরিচিত জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, নোবেলজয়ী চিকিৎসক ড. ডেনিস মুকওয়েগে, ও বহু ফিলিস্তিনি, ইউরোপীয়, আমেরিকান এবং এশীয় প্রতিনিধিরা।

কিন্তু এই ফ্লোটিনা যখন গাজার উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখনই তা ইসরায়েলি নৌবাহিনীর দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়। শুরু হয় নাটকীয় এক সংঘর্ষ— যা আজ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ২০১০ সালের সেই ঐতিহাসিক “মভি মারমারা” ট্র্যাজেডিকে, যেখানে ফিলিস্তিনের জন্য সহায়তা বহনকারী একটি ফ্লোটিনায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছিলেন ১০ জন তুর্কি নাগরিক। তখন থেকেই প্রশ্ন উঠেছিল:

‘সুমুদ’ ফ্লোটিনা যেন সেই ইতিহাসেরই আধুনিক সংস্করণ— তবে আরও বড়, আরও আন্তর্জাতিক, এবং মিডিয়ার নজরে অনেক বেশি।

গত ১৭ বছর ধরে ইসরায়েল গাজা উপত্যকাকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে স্থল, নৌ ও আকাশপথে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। খাদ্য, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ এমনকি পানীয় জলের সরবরাহও সেখানে সীমিত।
বর্তমানে, ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, ৭০% গাজাবাসী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, শিশুদের পুষ্টিহীনতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে এবং হাসপাতালগুলো কার্যত অকেজো।

এমন পরিস্থিতিতে যখন কোনো আন্তর্জাতিক মানবিক ফ্লোটিনা গাজা অভিমুখে যাত্রা করে, তখন তা শুধু সহায়তা নয়, আন্তর্জাতিক বিবেকের পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।

এই বছরের সেপ্টেম্বরে ইউরোপের বিভিন্ন বন্দর থেকে রওনা হয় ৫০টি জাহাজ। তাদের সঙ্গে ছিল খাবার, ওষুধ, সোলার জেনারেটর, পানিশোধক যন্ত্র, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও শিশুদের জন্য শিক্ষাসামগ্রী।
প্রতিটি জাহাজের ডেকে ছিল জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনবিরোধী বার্তা।

কিন্তু ১ অক্টোবর, গাজার উপকূল থেকে মাত্র ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে পৌঁছানোর আগেই, ইসরায়েলি নৌবাহিনী অভিযান চালিয়ে প্রায় ১৩টি জাহাজ বোর্ড করে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং অনেককে আশদোদ বন্দরে নিয়ে যায়।

গ্রেটা থুনবার্গ সহ অনেকেই আটক হন, যদিও পরে ইসরায়েলি বাহিনী জানায়, তারা “সুরক্ষিত এবং নির্যাতনমুক্তভাবে হেফাজতে রয়েছেন”।

ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

  • তুরস্ক, স্পেন, আয়ারল্যান্ডমালয়েশিয়া ইসরায়েলি হস্তক্ষেপকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে।
  • জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে: “যদি এই ফ্লোটিনা আন্তর্জাতিক জলসীমায় আটক করা হয়ে থাকে, তাহলে তা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন।”
  • ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। স্পেন ও আয়ারল্যান্ড সরাসরি নিন্দা করলেও, ফ্রান্স ও জার্মানি কূটনৈতিকভাবে “উদ্বেগ” প্রকাশ করে সীমিত থেকেছে।

ইসরায়েলের যুক্তি, গাজা একটি “অ্যাকটিভ ওয়ার জোন” এবং সেখানে নৌ অবরোধ বজায় রাখার অধিকার তাদের রয়েছে। তারা দাবি করে, “এধরনের জাহাজে অস্ত্র বা সন্ত্রাসীদের প্রবেশ ঠেকাতে এই পদক্ষেপ জরুরি।”

কিন্তু আন্তর্জাতিক নাব্য আইন (Law of the Sea) অনুসারে, আন্তর্জাতিক জলসীমায় কোনো মানবিক সহায়তা জাহাজ যদি অস্ত্রবিহীন থাকে ও যথাযথভাবে পূর্বঘোষণা দেয়, তবে সেটিকে বাধা দেওয়া অবৈধ

তাহলে প্রশ্ন জাগে — এই অভিযান কি ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি ছিল, নাকি তা ছিল মানবিক সহায়তার প্রতীকমাত্র?

‘সুমুদ’ ফ্লোটিনা এখন গাজার উপকূলে, তার বার্তা পৌঁছে গেছে পৃথিবীর প্রতিটি বিবেকবান মানুষের কাছে:

  • মানবতা এখনও বেঁচে আছে, যতদিন মানুষ জীবন বিপন্ন করে অন্যের পাশে দাঁড়ায়।
  • অবরোধের নামে এক জাতির ওপরে দমননীতি চলতে পারে না
  • আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের বিষয়গুলো শুধু কাগজে-কলমে নয়, বাস্তব প্রয়োগে দেখা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকার এখনও এই ঘটনায় কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে দেশের বহু নাগরিক সামাজিক মাধ্যমে এই ফ্লোটিনার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন ইস্যুতে সবসময়ই সোচ্চার থেকেছে। ‘সুমুদ’ ফ্লোটিনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে আরও সক্রিয় কূটনৈতিক ভূমিকা রাখতে হবে, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও ওআইসি’র মাধ্যমে।

‘সুমুদ’ ফ্লোটিনা হয়তো ইসরায়েলি বাধা অতিক্রম করতে পারেনি, তবে এটি বিশ্ব বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে। এটি শুধুমাত্র একটি মানবিক সহায়তা মিশন নয় — বরং এটি একটি নৈতিক আন্দোলন, একটি প্রতিবাদের প্রতীক।

গাজার শিশুদের জন্য, যারা প্রতিদিন মৃত্যুভয়ে ঘুমায়; তাদের জন্য এই ফ্লোটিনা যেন এক আশার আলো।

এখন আমাদের পালা— আমরা কি সেই আশাকে টিকিয়ে রাখতে পারবো?

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখায় উল্লিখিত তথ্যসমূহ ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও স্বাধীন উৎস থেকে প্রাপ্ত। পরিস্থিতি পরিবর্তনশীল।

inside post
আরো পড়ুন