আলো জাগে যেখানে

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
দুঃসময় পেরিয়ে সুসময়ের অভিযাত্রা
মানুষ যখন দুঃসময় পার করে, তখন সে কেবল ইতিহাসের ভেতর দিয়ে হাঁটে না—সে নিজেই একদিন ইতিহাস হয়ে ওঠে। আজ বাংলাদেশের প্রতিটি পথে, প্রতিটি মানুষের চোখে যে ছায়া আমরা দেখি, তা নিছক হতাশার চিহ্ন নয়—তা এক নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা, এক আগুন ঝরা আকাঙ্ক্ষা, পরিবর্তনের একটি গর্ভবতী মুহূর্ত।
বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে আছে এক ক্রান্তিকালের দ্বারপ্রান্তে। একদিকে লুটেরা রাজনীতি, অনাচার, বৈষম্য, শোষণ—অন্যদিকে জনগণের আশা, সাহস, জেগে ওঠা চেতনা আর সুবিচারের আগুন। এই দুই বিপরীতের সংঘাতে গড়ে উঠছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।
আমাদের সময়: সংকটের ছায়া, সম্ভাবনার সূর্য
আজকের পৃথিবী আর আগের পৃথিবী এক নয়। শত সহস্র পরমাণু বোমা, ট্রিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বাণিজ্য, ও বাজার নির্ভর কর্পোরেট দানবদের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে মানব সভ্যতা। পৃথিবীর একপ্রান্তে শিশুরা খেতে পায় না, অন্যপ্রান্তে কোটি ডলারে বিক্রি হয় এক রাতের নৈশভোজ। এই অমানবিক বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়—এটি নৈতিক, এটি অস্তিত্ববাদী।
বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক সংকট থেকে মুক্ত নয়। আমরা দেখছি—
- তরুণরা দিনরাত পরিশ্রম করেও কাজ পাচ্ছে না।
- কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না।
- শ্রমিক শ্রম দিচ্ছে, অথচ শ্রমের মর্যাদা পাচ্ছে না।
এই ভূখণ্ডে আছে অফুরন্ত সম্ভাবনা, কিন্তু সেই সম্ভাবনার গলা চেপে ধরা হয়েছে দুর্নীতি, দুঃশাসন আর নৈতিক অবক্ষয়ের হাত ধরে।
প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে মানুষ
এখানেই প্রশ্ন জেগে ওঠে—
মানুষ কি কেবল টিকে থাকার জন্য সৃষ্টি? নাকি সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার তার জন্মগত?
এই প্রশ্ন আজ বাংলাদেশে নয়, গোটা পৃথিবীর দরজায় কড়া নাড়ছে। মানবতার চেয়ে বড় আর কোনো ধর্ম নেই, কোনো রাজনীতি নেই, কোনো জাতীয়তা নেই।
যে রাজনীতি মানুষকে কাঁদায়, সে রাজনীতি নয়—সে অন্যায়। যে অর্থনীতি গুটিকয়েক মানুষের হাতে পৃথিবীর সম্পদ কুক্ষিগত করে, তা সভ্যতার নয়—তা দানবীয়তার।
দায়িত্ববোধের আলো: আশার দিশা
তবুও আমরা আশাবাদী। কারণ ইতিহাস বলে—অন্ধকার চিরকাল থাকে না। মানুষের জাগরণই একমাত্র আলো।
গ্রামের কৃষক, শহরের রিকশা চালক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, গার্মেন্টসের মেয়েটি, কিংবা চিকিৎসার অপেক্ষায় থাকা বৃদ্ধ—সবাই যদি এক সুতোয় বাঁধা পড়ে, তবে ইতিহাস বদলাতে সময় লাগে না।
কেননা মানুষের মধ্যে আছে এক মহাজাগতিক শক্তি—সংগ্রাম করার, প্রতিকূলতাকে জয় করার, অন্ধকার ভেদ করে আলো খুঁজে নেবার।
অসাম্যের দেয়াল ভাঙার সময় এসেছে
আমাদের সমাজে তৈরি হয়েছে এক অবিচারের প্রাচীর—
- ধনী ও দরিদ্রের মাঝখানে দুর্ভেদ্য ব্যবধান।
- শহর ও গ্রামের মাঝে উন্নয়নের অদৃশ্য দেয়াল।
- ক্ষমতাবান ও প্রান্তিক মানুষের মাঝে এক অবর্ণনীয় বৈষম্য।
এই দেয়াল আর রাখা যাবে না। মানুষের মানবিক মর্যাদা তার আর্থিক অবস্থা দিয়ে নয়, তার অধিকার, তার সম্মান ও তার স্বপ্ন দিয়ে নির্ধারিত হওয়া উচিত।
একটি সত্যিকারের সভ্য সমাজ তখনই গড়ে ওঠে, যখন কেউ কারও ক্ষুধায় নির্লিপ্ত থাকে না, যখন অন্যের কান্না আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, যখন কারও দারিদ্র্যকে আমরা শুধু পরিসংখ্যান নয়, একজন জীবন্ত মানুষের আর্তনাদ হিসেবে অনুভব করি।
সম্ভাবনার দেশ, নেতৃত্বের সংকট
বাংলাদেশে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ, জনশক্তি ও কৌশলগত অবস্থান রয়েছে, তাতে এটি শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়—বিশ্ব অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হতে পারত।
কিন্তু যেখানে নেতৃত্ব ন্যায়ের পরিবর্তে স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, যেখানে গণতন্ত্র নামকাঠামোয় বন্দি, সেখানে সম্ভাবনাও পঙ্গু হয়ে পড়ে।
এ জন্য চাই—
- নতুন ধরনের নেতৃত্ব—যারা শুধু শাসক নয়, পথপ্রদর্শক হবে।
- নৈতিক রাজনীতি, যা জনগণের পাশে দাঁড়াবে।
- জনগণের ঐক্য, যা স্বপ্ন দেখে, আবার সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য জেগেও ওঠে।
- সত্যিকার পরিবর্তন: নিচ থেকে উপরে
কোনো সুসময় উপরে বসে থাকা শাসকের ইচ্ছায় আসে না, তা আসে সাধারণ মানুষের নিরলস ত্যাগে।
কৃষকের রক্ত, শ্রমিকের ঘাম, শিক্ষার্থীর প্রতিবাদ, নারীর প্রতিরোধ—এসব মিলেই গড়ে ওঠে পরিবর্তনের পথ।
আমরা ইতিহাসে দেখেছি—
- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গরিব চাষিরাও নেতৃত্ব দিয়েছে।
- দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পথশিশুরাও অংশ নিয়েছে।
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহরের ছেলে, গ্রামের মেয়ে, সবার রক্ত লেগেছে।
- এইতো সেদিন জুলাই বিপ্লব দেখেছি।
এই সত্য আমাদের শেখায়—পরিবর্তনের ক্ষমতা কেবল ক্ষমতাবানদের হাতে নেই, আছে আমাদের সবার মাঝেই।
মানুষই ভবিষ্যৎ রচনা করে
মানুষের মাঝে লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতের নকশা। তার মস্তিষ্কে জাগে প্রশ্ন, তার হৃদয়ে জ্বলে আশা, তার হাতে গড়ে ওঠে নতুন দিনের প্রতিচ্ছবি।
আজ বাংলাদেশ, আর সব দেশের মতোই, সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে—যেখানে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কেমন ভবিষ্যৎ চাই?
চাই কি আমরা এক ন্যায়ভিত্তিক সমাজ, যেখানে প্রতিটি শিশু নিরাপদে ঘুমাবে?
চাই কি আমরা এমন একটি বিশ্ব, যেখানে যুদ্ধ নয়, শান্তি হবে কূটনীতির ভাষা?
চাই কি আমরা এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে দারিদ্র্য নেই, বঞ্চনা নেই, কেবল মানবতার বিজয়গাথা?
একসাথে আলোয় যাই
সুসময় কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। এটি আসে মানুষের সংগ্রাম, স্বপ্ন আর সাহসের চাষে।
আজ যদি আমরা হাত ধরাধরি করি—শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, নারী, পুরুষ, তরুণ, প্রবীণ—তবে এই দুঃসময় কিছুই নয়, কেবল একটি অন্ধকার রাত, যার শেষে সূর্য অপেক্ষা করছে।
মানুষের শক্তিই চূড়ান্ত শক্তি। সেই শক্তিকে যদি আমরা নৈতিকতা, মানবতা আর ঐক্যের আলোয় জাগিয়ে তুলি, তবে কোনো দুঃসময়ই চিরস্থায়ী হতে পারবে না।“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে…” — এই গান শুধু কবিতার নয়, এটি সংগ্রামের নির্দেশ।
আজ আপনাকেই হতে হবে সেই প্রথম প্রদীপ, যেটি জ্বাললে গোটা সমাজ আলোয় ভরে যাবে।
