একজন সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরী

সত্যের অনল জ্বালিয়ে রেখে গেলেন-
মনোয়ার হোসেন রতন।।
কুমিল্লার পবিত্র মাটি যুগে যুগে জন্ম দিয়েছে নানা মহীরুহ, যারা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন জ্ঞানে, গুনে, মননে, আদর্শে ও কর্মে। তেমনি এক উজ্জ্বল নাম—সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরী। তিনি শুধু সংবাদপত্রের কলমধারী ছিলেন না, ছিলেন মননের আলোকবর্তিকা, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক এবং মানবিক মূল্যবোধের নির্ভরযোগ্য কাণ্ডারি। আজ তিনি নেই, কিন্তু রেখে গেছেন এমন এক সত্য ও আদর্শের অনল, যা প্রজন্মকে পথ দেখায়।
জন্ম ও শৈশব: আদর্শ গঠনের বীজ রোপণ
১৯৩০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার চন্দনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গোলাম মোস্তফা চৌধুরী। সেই সময় ছিল উপমহাদেশীয় ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ—বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি তখন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে অবতীর্ণ। শৈশবেই তাঁর মধ্যে বপিত হয় আদর্শ, সত্যনিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের বীজ।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ পোশাক আগুনে নিক্ষেপ করে কুমিল্লার খদ্দর বস্ত্র পরিধানের ব্রত নেন তিনি। আত্মশুদ্ধির সে সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর জীবনের অন্তর্নিহিত আদর্শচর্চার পরিচয়।
সাংবাদিকতার পথচলা: সত্যের কলমযোদ্ধা
সাংবাদিকতা তাঁর কাছে ছিল জীবিকা নয়, ছিল নৈতিক দায়িত্ব। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক-এর কুমিল্লা প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত হয়ে ষাট ও সত্তরের দশকের রাজনৈতিক টালমাটাল সময়ে সত্য ও বিবেকের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর লেখনী ছিল গবেষণাধর্মী, মানবিক এবং সমাজ-সচেতন। আপসহীন মনোভাব নিয়ে কখনো মিথ্যার সাথে আঁতাত করেননি, নীতিগত প্রশ্নে কখনো পিছু হটেননি।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি এবং কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বে কুমিল্লায় সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠা পায় এক বলিষ্ঠ ভিত্তির উপর।
সংস্কৃতির অকৃত্রিম অভিভাবক
“সংস্কৃতি ছাড়া মনন গড়ে না”—এ বিশ্বাসে তিনি তাঁর কান্দিরপাড়ের বাড়িকে পরিণত করেছিলেন এক সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। তাঁর বাসায় হতো কবিতা, গান, নাটক, আবৃত্তি ও চিত্রকলার চর্চা। তাঁর প্রেরণায় অনেক কিশোর-কিশোরী শিল্প-মনস্কতায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
কুমিল্লার স্কুল-কলেজগুলোতে চালু করেন সংস্কৃতি চর্চার ধারা—কচিকাঁচা মেলা, আবৃত্তি উৎসব, নাট্য প্রতিযোগিতা—যেগুলোর তিনি ছিলেন মূল পৃষ্ঠপোষক ও সংগঠক।
শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে নিরব বিপ্লবী
লাকসামের ‘উত্তরদা জুনিয়র স্কুল’ তাঁর উদ্যোগেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। নারী শিক্ষার বিস্তারে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। কুমিল্লা মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী হাসিনা চৌধুরী ছিলেন ফরিদা বিদ্যায়তনের বিশিষ্ট শিক্ষিকা। এ পরিবার যুগের পর যুগ শিক্ষার আলো ছড়িয়ে চলেছে।
উত্তরাধিকার ও পারিবারিক মননচর্চা
তাঁর সন্তানরাও আজ বয়ে চলেছেন সেই ঐতিহ্য। বড় ছেলে খালেদ মোস্তফা চৌধুরী জার্মানে বসবাস করছেন। অন্য ছেলে জুনায়েদ মোস্তফা চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাস্কর্যশিল্পী হিসেবে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। তাঁদের সৃষ্টির মধ্য দিয়েই বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে গোলাম মোস্তফা চৌধুরীর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
মনীষীদের সান্নিধ্যে নির্মিত আদর্শজীবন
তিনি ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্নেহভাজন। সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, যিনি বলেছিলেন, “মাতৃভাষা বাঁচলে জাতি বাঁচে”—এ বাণীই ছিল তাঁর অন্তরে ধারণ করা দর্শন। তিনি ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, তোয়াব খান, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ মোস্তাফা আলী, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, বেগম সুফিয়া কামাল, মোস্তফা মনোয়ার ও কামরুল ইসলামের মতো মনীষাদের সাহচর্যে সমৃদ্ধ।
এ সম্পর্ক কেবল আনুষ্ঠানিক সৌজন্য ছিল না, ছিল চিন্তা ও চেতনার গভীর বন্ধন—যার মূল ছিল সত্য, সেবা, আত্মনিবেদন ও সাংস্কৃতিক জাগরণ।
শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি
২০২৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, তাঁর ৯৫তম জন্মবার্ষিকীতে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত হয় ‘সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরী স্মৃতি স্কুল ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা’। আয়োজনে মুখ্য ভূমিকা রাখে ‘পূর্বাশা’ ও ‘মধুমিতা’ কচিকাঁচা মেলা।’ একইসঙ্গে, কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয় তাঁর নামে—’সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরী সড়ক’। এটি তাঁর স্মৃতির প্রতি একটি গর্বিত শ্রদ্ধা ও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
অনুসরণের আলো
যখন আজকের সমাজে সত্য বলা একপ্রকার বিপজ্জনক সাহসিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন গোলাম মোস্তফা চৌধুরীর জীবন আমাদের শেখায়—সত্যকে ভালোবাসলে ভয় থাকে না। তিনি ছিলেন দীপ্তিময় নায়ক, যিনি কর্ম, চিন্তা ও বিশ্বাস দিয়ে একটি সমাজকে আলোকিত করেছিলেন।
আমরা প্রার্থনা করি—তাঁর রেখে যাওয়া সত্য, আদর্শ ও মননের আলোক রেখা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হোক অনন্ত প্রেরণার পথ।
এখানে উল্লেখ্য যে, ২০২৪ সালের ১০ মার্চ, কুমিল্লার সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘রৌদ্রজল’ আয়োজন করে স্মারক গ্রন্থ পাঠ উন্মোচন ও বসন্তপূরণ অনুষ্ঠান, যার শিরোনাম ছিল: “বিচিত্র বর্ণিল গোলাম মোস্তফা চৌধুরী”। বসন্তের গরমে আয়োজিত সে দিনটি ছিল না কেবল ঋতুচেতনার, ছিল এক গৌরবোজ্জ্বল জীবন ও আত্মত্যাগের রঙে ফুটে ওঠা প্রাণবন্ত মুহূর্তের সাক্ষ্য।
সবার কণ্ঠে ছিল এক উচ্চারণ—
“গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ছিলেন সত্যিকারের সাংবাদিক, যাকে হারিয়ে আমরা শুধু একজন মানুষ নয়, একটি দর্শন হারিয়েছি।”
লেখক:সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা চৌধুরীর ভাগিনা।
inside post
আরো পড়ুন