একুশ শতকের মানুষ ও রাষ্ট্র: উন্নয়ন না বৈষম্য?

মনোয়ার হোসেন রতন।।
একুশ শতকের পৃথিবী নিঃসন্দেহে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও উন্নয়নের এক অপূর্ব নিদর্শন। মহাকাশ জয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বৈশ্বিক যোগাযোগ থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নব আবিষ্কার—মানব সভ্যতা এগিয়েছে অভূতপূর্ব গতিতে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই উন্নয়নের ভিতরে মানুষ কোথায়? রাষ্ট্র আসলে কার সেবায় নিয়োজিত?
আজও পৃথিবীর নানা প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ, দুর্নীতি ও বৈষম্যের অদৃশ্য শৃঙ্খলে মানুষ বন্দি। রাষ্ট্রযন্ত্র, যা গড়ে উঠেছিল জনগণের সেবায়, তা আজ পরিণত হয়েছে ক্ষমতার দুর্গে—যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত। জনগণ যেন ভোটের দিনে গুরুত্বপূর্ণ, আর বাকি সময় তারা নিছক দর্শক।
রাজনীতি থেকে ক্ষমতার খেলায়
অ্যারিস্টটল বহু আগেই বলেছিলেন, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে রাজনৈতিক প্রাণী। রাজনীতি মানুষকে মুক্তি দেবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে—এমন প্রত্যাশাই ছিল। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে কেবল ক্ষমতার খেলা। দলীয় স্বার্থ ও ব্যক্তিগত লোভের কাছে মানুষের অধিকার, ন্যায় ও মানবিকতা প্রতিনিয়ত বলি হচ্ছে।
জন লক, হবস কিংবা রুশো—যাঁরা সামাজিক চুক্তির ধারণা দিয়েছেন—তাঁদের ভাবনায় রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে ছিল পারস্পরিক দায়বদ্ধতা। রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেবে, মানুষ রাষ্ট্রকে মেনে চলবে। অথচ বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্র অনেক সময় নাগরিককে তুচ্ছ করে, শাসনযন্ত্রে রূপান্তরিত হয়।
পুঁজিবাদের দখলদারিত্ব
আজকের পৃথিবীতে পুঁজিবাদ হলো প্রধান চালিকা শক্তি। কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর বৈষম্য। একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট বলছে—বিশ্বের ৮২ শতাংশ সম্পদ কেবল এক শতাংশ মানুষের হাতে। শ্রমিকরা প্রতিদিন ৮–১২ ঘণ্টা খেটে মৌলিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়, অন্যদিকে মুষ্টিমেয় ধনী রাতারাতি কোটি কোটি ডলার উপার্জন করে। এই ব্যবস্থায় মানুষ নয়, মূল চালিকা শক্তি হলো পুঁজি ও মুনাফা।
প্লেটো তাঁর দ্য রিপাবলিক-এ কল্পনা করেছিলেন এক ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের, যেখানে শাসক হবেন জ্ঞানী ও দয়ালু। কনফুসিয়াস বলেছিলেন, শাসক হবেন পিতার মতো, জনগণ তাঁর সন্তানসম। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় রাষ্ট্র যেন ধনীদের অভিভাবক, আর দরিদ্ররা কেবল ত্যাগের প্রতীক।
গণতন্ত্র নাকি আমলাতন্ত্র?
গণতন্ত্রের মূল কথা—“জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।” অথচ বাস্তবে গণতন্ত্র অনেক সময় আমলাতন্ত্রে পরিণত হয়। ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে ঠিকই, কিন্তু কাঠামো অপরিবর্তিত থেকে যায়। জনগণের বদলে দলীয় আনুগত্যই হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্র চালনার মূল নীতি।
ফলে গণতন্ত্র রূপ নেয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার রাজনীতিতে—যেখানে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাই আইন হয়ে দাঁড়ায়।
নৈতিক শূন্যতার সংকট
আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সংকট হলো নৈতিক শূন্যতা। রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠান—সব জায়গায় আমরা দেখি লাভ-লোকসানের হিসাব। মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র গঠনের যে সামাজিক চুক্তি একসময় মানবিকতার ওপর দাঁড়িয়েছিল, আজ তা পরিণত হয়েছে দলীয় চুক্তি ও ক্ষমতার সমঝোতায়।
আশার আলো কোথায়?
তবুও পৃথিবী সম্পূর্ণ অন্ধকার নয়। এখনও কিছু মানুষ আছেন—যাঁরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন। তাঁদের স্বপ্নই পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখে। কারণ রাষ্ট্রের আসল শক্তি তার জনগণ। রাষ্ট্র তখনই সফল, যখন দরিদ্রতম মানুষটিও বলতে পারে—“এ দেশ আমার, রাষ্ট্র আমার।”
কল্যাণরাষ্ট্রের প্রয়োজন
এখন জরুরি হয়ে উঠেছে নতুন করে ভাবা—রাষ্ট্র কী, শাসন কেন, এবং মানুষের জন্য কীভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থা সাজানো উচিত। আমাদের প্রয়োজন একটি কল্যাণরাষ্ট্র—যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও জীবনের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত হবে সবার জন্য। যেখানে আইন হবে ন্যায়ভিত্তিক, শাসন হবে জনকল্যাণকেন্দ্রিক; ক্ষমতার প্রদর্শনী নয়।
একুশ শতকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে রাষ্ট্র যদি কেবল ধনীদের দুর্গে পরিণত হয়, তবে তা সভ্যতার জন্য ভয়ঙ্কর বিপর্যয় বয়ে আনবে। রাষ্ট্রের মূল শক্তি জনগণ—তাদের অবহেলা করে কোনো রাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
তাই আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো মানবিকতা পুনরুদ্ধার, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন। উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হবে, যখন প্রতিটি শিশুর ঠোঁটে উচ্চারিত হবে—“এই দেশ আমার, রাষ্ট্র আমার, সরকার আমার।”
