পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে মতিন সৈকতের জাতীয় পরিবেশ পদক অর্জন
পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে মতিন সৈকতের জাতীয় পরিবেশ পদক অর্জন কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার আদমপুরের মতিন সৈকত ২০২১ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাক্তিগত ক্যাটাগরিতে দেশ সেরা একক ব্যাক্তি নির্বাচিত হয়েছেন। ৫ জুন রবিবার আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস উদযাপন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সন্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালিভাবে উপস্থিত থেকে জাতীয় পরিবেশ পদক প্রদান করেন। এ সময় মতিন সৈকতের হাতে জাতীয় পরিবেশ পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী’র পক্ষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোঃ সাহাব উদ্দিন এমপি, উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার এমপি, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী, সচিব ড, ফারহিনা আহমেদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মতিন সৈকত-কে তার অসাধারণ অবদানের জন্য তিনবার জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করেন। পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ব্যাবহার এবং সম্প্রসারণের জন্য ২০১০ এবং ২০১৭ সালে দুইবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রদান করেন। মতিন সৈকত ১৯৮৭ সালে সৃজনশীল কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ -এর লেখা অভিনন্দন পত্র পান। পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে তিনি ছয় বার সরকারিভাবে চট্টগ্রাম বিভাগে শীর্ষস্থান অর্জন করেন। মতিন সৈকত রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত কৃষি,পরিবেশ, সামাজ উন্নয়ন সংগঠক। বহুমুখী সৃজনশীল উদ্ভাবক-উদ্যোক্তা। মতিন সৈকত তিন দশকের বেশি সময় ধরে কৃষি পরিবেশ সমাজ উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দৃষ্টান্ত স্হাপন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা সাহিত্যে সন্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে স্হায়ীভাবে গ্রামে বসবাস করেন। স্হানীয় প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার পাশাপাশি কৃষি, পরিবেশ, সামাজিক উন্নয়নে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষমুক্ত ফসল, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, খাল-নদী পূনঃখনন, জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণে কাজ করেন। শহর-নগরের বর্জ্য -ময়লা-আবর্জনা থেকে সিটিজেন ফার্টিলাইজার বা নাগরিক সার রুপান্তরের জন্য সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন। গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নে নতুন রাস্তা, বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গণশেয়ারের মাধ্যমে সমাজ ভিত্তিক এক ফসলি বোরোধানের আবাদ সঠিক রেখে প্লাবন ভূমিতে মৎস্য চাষ সম্প্রসারণে অবদান রেখে সমবায়ের মাধ্যমে জনগণের সম্পৃক্ততায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সৃষ্টি করেন। মতিন সৈকত ২০০০ সাল থেকে বিষমুক্ত সবজি নিরাপদ ফসল উৎপাদন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রত্যেক বছর ফসলের মৌসুমে ঢোল পিটিয়ে, মাইকিং করে কৃষককে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে আগ্রহী করে তুলছেন। মতিন সৈকত দেশব্যাপী পরিবেশ আন্দোলন, জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, খাল-নদী পূনঃখনন আন্দোলন, পলিথিন প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে জন-সচেতনতা সৃষ্টি করছেন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, পাখি উদ্ধার এবং অবমুক্তি নিয়ে সংগ্রাম করছেন। তার উদ্ধার এবং অবমুক্তকৃত পাখির সংখ্যা ১৫০০’র বেশি। বোরোধান উৎপাদন করতে মৌসুমব্যাপী সারাদেশে সেচের পানির জন্য সেচ প্রকল্পের মালিককে বিঘাপ্রতি ১০০০থেকে ২০০০ টাকা সেচের খরচ দিতে হয়। মতিন সৈকত ১৯৯৭ সাল থেকে আদমপুর, পুটিয়া ও সিঙ্গুলা তিন গ্রামের মধ্যবর্তী আপুসি বোরোধানের প্রকল্পে ধান লাগানো থেকে পাকা ধান কাটা পর্যন্ত ২৭ বছর যাবত যার যতোবার সেচের পানি প্রয়োজন ততোবারই সেচের পানি এককালীন মাত্র দুইশ টাকার বিনিময়ে বিঘাপ্রতি মৌসুমব্যাপি সরবরাহ করে ধান উৎপাদনে সহযোগিতা করে জাতীয় দৃষ্টান্ত স্হাপন করেন। তিনি প্রত্যেক বছর বোরোধানের জমিতে ঝাটা-জিংলা পুতে দেন যাতে পাখি বসে পোকামাকড় খেয়ে ফসলকে নিরাপদ রাখে। বিষ মাটি, পানি, বাতাস, ফসল ও অর্থ নষ্টের পাশাপাশি জনস্বাস্থ ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। সেচের পানির উৎস কালাডুমুর নদী মতিন সৈকতের উদ্যোগে সরকারি অর্থায়নে ১১ কিলোমিটার পূনঃখনন হয়েছে। যার ফলে চারটি উপজেলার প্রায় পঞ্চাশ হাজার বিঘা জমিনের আনুমানিক ১২,৫০,০০০ মণ বোরোধান উৎপাদনে সহায়ক হয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গণশেয়ারের ভিত্তিতে স্হানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে ২০০০ সালে মতিন সৈকত সমাজভিত্তিক আদমপুর, পুটিয়া, সিংগুলা তিন গ্রামের মধ্যবর্তী ২৫০ বিঘা জমিতে আপুসি মৎস্য চাষ প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন। পুটিয়ায় ১০০ বিঘা জমিতে বিসমিল্লাহ এবং আদমপুর, পুটিয়া, বিটমান তিন গ্রামের মাঝখানে প্রায় ৪০০ বিঘা জমিতে আপুবি মৎস্য চাষ প্রকল্প সমবায় ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করেন। ২০২০ সালে সারাদেশে মাত্র ১০টি ইউনিয়নকে সরকারিভাবে আইপিএম মডেল ইউনিয়ন ঘোষণা করে কৃষি মন্ত্রণালয়। পরিবেশ বান্ধব কৌশল অবলম্বনে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে মতিন সৈকতের ইলিয়টগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়ন আইপিএম মডেল ইউনিয়নের স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০১৭ সালে উপজেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা শিসউক, মতিন সৈকতের নেতৃত্বাধীন দাউদকান্দি উপজেলা কেন্দ্রীয় আইপিএম-আইসিএম ক্লাবের সমন্বয়ে জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা F A O দাউদকান্দি উপজেলাকে নিরাপদ খাদ্য উপজেলা ঘোষণা করে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি সবুজায়ন আন্দোলনের গড়ে তুলেন। মতিন সৈকত বাংলাদেশ পরিবেশ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। আদমপুর আদর্শ কমপ্লেক্সেের চেয়ারম্যান। দাউদকান্দি উপজেলা কেন্দ্রীয় আইপিএম-আইসিএম ক্লাবের সভাপতি। কৃষি পরিবেশ আন্দোলন কৃপা’র সভাপতি। পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র সদস্যসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। মতিন সৈকত -কে নিয়ে ‘অব দ্যা বেটেনটেক দি ক্রপ ক্রুসেডার, এরিয়েল প্রেট্রিয়ট, এম্যান টুবিফলোইড, এন লাইটেড মতিন সৈকত, মতিন সৈকত এরিয়েল ফ্রেন্ড অব ফারমার্স ইন কুমিল্লা শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মতিন সৈকত-কে নিয়ে শাইখ সিরাজ, রেজাউল করিম সিদ্দিক, রামেন্দু মজুমদার, মুন্নী সাহা, প্রভাষ আমিন, সাদিয়া ওহাব -রোম্মান রশিদ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। বিবিসি টেলিভিশন মতিন সৈকত-কে নিয়ে একাধিক তথ্য চিত্র সম্প্রচার করেন। দাউদকান্দি উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ সারোয়ার জামান বলেন ‘আদমপুর গ্রামের পরিবেশযোদ্ধা মতিন সৈকত উপজেলার কৃষকদের খুব আপনজন। সরকারের পাশাপাশি তৃণমূলে কৃষকের পাশে থেকে সব সময় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। তিনি ৩০ বছর ধরে নাম মাত্র মূল্যে মাত্র দুইশ টাকায় বিঘাপ্রতি সেচ ব্যবস্থা করে কৃষকদের সেবা দিয়ে আসছেন। তিনি কৃষকদের যেভাবে সংগঠিত করে তাদের সহযোগিতা করছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।’ দাউদকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজর (অবঃ) মোহাম্মদ আলী সুমন উল্লেখ করেন। “মতিন সৈকত কৃষি ও পরিবেশ উন্নয়নে ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে দেশব্যাপী দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছেন। বিষমুক্ত ফসল, নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন, খাল-নদী পূনঃখনন, বন্য প্রাণীসহ পাখি উদ্ধার ও অবমুক্ত, জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি বহুমুখী সামাজিক আন্দোলন করে যাচ্ছেন। মহাসড়কের দুই পাশের ময়লা আবর্জনা, শহর- নগরের বর্জ্যকে রুপান্তরিত করে সিটিজেন ফার্টিলাইজার বা নাগরিক সার তৈরি কারার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানিয়ে আসছেন। কালাডুমুর নদী পূনঃখনন মতিন সৈকতের আন্দোলনের ফসল। কৃষি, পরিবেশ, সামাজিক উন্নয়নে নিবেদিত মতিন সৈকত।’ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বিশিষ্ট সমাজ বিশ্লেষক, প্রযুক্তিবিদ অশোক কুমার সিনহা বলেন ‘মতিন সৈকত খুব ভালো কাজে জীবনকে অর্থবহ রেখেছেন। চারিদিকের প্রাকৃতিক দূষণ, সামাজিক দূষণ , রাজনৈতিক দূষণের মধ্যেও তাঁর মত মানুষ’রা ভরসা। পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকুক এর থেকে বড় চাওয়া আর কি থাকতে পারে। আর মানুষ তো একক নয়, আছে পরিবার, সমাজ, দেশ, প্রকৃতি, জীবজন্তু-পাখি, সমগ্র প্রাণী জগত। প্রত্যেকে ভালো থাকলেই সবাই ভালো থাকবে, আলাদাভাবে কারও ভালো থাকা সম্ভব নয়। মতিন সৈকতের নদী-খাল বাঁচানোর লড়াই পরিবেশ আন্দোলনের এক গৌরবজনক অধ্যায়। তাঁকে দেখে নদীমাতৃক দুই বাংলার মানুষ নদী-খাল বাঁচানোর লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত হোক।’ পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক শওকত আরা কলি জানান ‘জেলায় পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মতিন সৈকতের নানা কর্মকান্ড সত্যিই আমাদের মুগ্ধ করেছে। সরকারি কোন সহায়তা ছাড়াই সমাজে পরিবেশের জন্য যদি কেউ কাজ করে থাকে তাহলে মতিন সৈকত হতে পারেন মডেল।’ জাতীয় সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল অবঃ মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূইয়া বলেন ‘ মতিন সৈকত দুই দশকের বেশি সময় ধরে কৃষি পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করে জাতি গঠনে অবদান রাখছেন।”