রক্তাক্ত বিপ্লবের গর্ভে জন্ম নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন স্বপ্ন

 

।। মনোয়ার হোসেন রতন ।। 

নিশ্চিন্ত জীবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, রাজনীতিবিদগণ আজ ভালোবাসার ব্যাকরণ শেখাচ্ছেন জাতিকে। অথচ এ জাতি তো রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গর্ভে নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেছিল। ৫৪ বছর আগে যারা প্রিয়জন হারিয়েছিল, যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে মানবিক গণতন্ত্রের স্বপ্ন বুনেছিল, আজ তাদের উত্তরসূরিরা স্বপ্ন দেখে—কবে এ রাষ্ট্র আবার মানুষের হবে!

বছরের পর বছর আমরা দেখেছি, নির্বাচনের নামে প্রহসন, উন্নয়নের নামে লুটপাট, আর গণতন্ত্রের নামে একচ্ছত্র শাসন। এ কল্পিত স্বাধীনতায় কণ্ঠরোধের রাজনীতি ছিল, ছিল মিথ্যার গণতন্ত্র। অবশেষে যে বিপ্লব ফুঁসে উঠল, তা ছিল না কেবল কোনো রাজনৈতিক দলের ডাক, বরং জনগণের ব্যথিত চেতনায় জন্ম নেওয়া আত্মদাহের আগুন। রক্ত ঝরেছে, প্রিয়জন হারিয়েছে অনেকেই—কিন্তু হার মানেনি তাদের আশাভরা চোখ।

এ বাস্তবতার মধ্য দিয়েই গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নেতৃত্বে রয়েছেন সম্মানিত ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস, যার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও মানবিক দর্শন নতুন এক আশার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এ সরকার কতটা সক্ষম হবে দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্যান্সার নির্মূলে? তারা কি পারবেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে? জনগণের বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে একটি স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অতীতের মতো শুধুমাত্র দলীয় পতাকা নয়, আজ জনগণের মুখে ফিরে এসেছে চেতনার শব্দ। ‘সচেতন নাগরিক’ পরিচয়টি এখন কেবল শহরের ক্যাফে থেকে নয়, গ্রামের বাজারেও উচ্চারিত হচ্ছে। ফেসবুক পোস্ট থেকে শুরু করে মাঠের মিছিল—সবখানেই এক নতুন বাস্তবতা: আমরা বাঁচতে চাই, ভালোবাসতে চাই—আমরা মানুষ হতে চাই।

রাজনীতি এখন আর কেবল ক্ষমতার টানাটানি নয়, এটা জীবন ও মৃত্যুর ব্যবধান। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচার—সব কিছু জড়িয়ে গেছে এই ব্যাকরণে। ভালোবাসা মানে কেবল আবেগ নয়, এটা রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থা, নেতৃত্বের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা। অথচ আমরা দেখেছি, কিভাবে এই ভালোবাসাকে পণ্য বানিয়ে বারবার বিক্রি করা হয়েছে নির্বাচনের বাজারে।

সুতরাং, আজকের দিনে এসে প্রশ্ন উঠতেই পারে—এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি শুধুই এক ‘ব্রেকিং নিউজ’, নাকি এটাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত পুনর্জাগরণের সূচনা? এই প্রশ্নের জবাব আমাদের সবাইকে মিলিয়ে দিতে হবে।

একদিকে রয়েছে প্রচলিত শাসনব্যবস্থার ক্লান্ত চেহারা—যেখানে দুর্নীতি, দমন-পীড়ন আর গণতন্ত্রহীনতার দায় নিয়ে মুখ নিচু করে ইতিহাসের পাতায় হোঁচট খাচ্ছে পুরনো রাজনীতি। অন্যদিকে উঠে আসছে এক নতুন বাস্তবতা—যেখানে মানুষ নিজের অধিকারের ব্যাকরণ নিজেই লিখতে শিখছে।

এই নতুন বাস্তবতা নির্মাণে আমাদের দরকার হবে শুদ্ধতা, স্বচ্ছতা এবং সাহস। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হতে হবে জনতার প্রতিনিধি, কোনো গোষ্ঠীর নয়। নতুবা এই সুযোগও হারিয়ে যাবে রাজনীতির চিরাচরিত নাট্যমঞ্চে।

আমরা যদি সত্যিই একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়তে চাই, তবে আমাদের রাজনৈতিক ব্যাকরণে ‘ভালোবাসা’ শব্দটি বসাতে হবে শিরোনামে—not just as a poetic flair, but as a foundational principle. এই ভালোবাসা হবে—অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং ভয়-ভীতি থেকে মুক্ত মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

তাই, এখনই সময়—সংবিধানের প্রতিটি পৃষ্ঠায়, রাজনীতির প্রতিটি ভাষ্যে, এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্তে মানুষকে ফেরানোর। যেন মানবিক রাষ্ট্রীয় চেতনায় ফিরে গিয়ে আমরা বলতে পারি—হ্যাঁ, আমরা শিখেছি ভালোবাসার ব্যাকরণ, শিখেছি রাষ্ট্র ও নাগরিকের একাত্মতার ভাষা।

inside post
আরো পড়ুন