ইসলামের খেদমাতে বঙ্গবন্ধুর অবদান

 

inside post

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রকৃত মুসলিম হিসেবে ব্যক্তি জীবনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার পাশাপাশি ইসলাম প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদান অপরিসীম। আল্লাহ তায়ালা ইসলামের বাণী প্রচার ও প্রসারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণী প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, “হে রাসূল! যা কিছু আপনার রবের পক্ষ থেকে আপনার উপর নাযিল করা হয়েছে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিন। যদি তা না করেন তাহলে তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলেন না।” (আল-মায়িদাহ: ৬৭) ইসলাম প্রচারের মহান ব্রত নিয়ে তাবলীগে দ্বীনের জন্য উপমহাদেশে ‘তাবলীগ জামায়াত’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯২৫ সালে। তখন রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি কমিউনিস্ট দেশ ছিল। সেখানে তাবলীগ জামাত প্রবেশের অনুমতি ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে, ফলে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাদের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ সুযোগে তিনি রাশিয়ায় ইসলাম প্রচারের জন্য প্রথম তাবলীগ জামাত প্রেরণ করেন। যা আজও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে অব্যাহত আছে। (বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, পৃ. ১৭৫।)ইসলামের প্রচার-প্রসারে বঙ্গবন্ধুর ইহা অনেক বড় অবদান। আবার প্রতি বছর ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে তাবলীগ জামায়াতের বার্ষিক সম্মেলন ‘বিশ্ব ইজতেমা’ অনুষ্ঠিত হয়। এতে হাজার হাজার লোক একত্রিত হয়। ইসলামি দাওয়াতের কাজ যাতে সুন্দরভাবে প্ররিচালিত হতে পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু টঙ্গীতে সুবিশাল জায়গা বরাদ্দ করেন। (বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, পৃ. ১৭৫) দ্বীনি দাওয়াত সম্প্রসারণের জন্য তাবলীগ জামায়াতের ঢাকার কাকরাইলের কেন্দ্রীয় মসজিদটি খুবই অপ্রশস্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু এ মসজিদের সম্প্রসারণের জন্য নির্দেশ দিয়ে জমি বরাদ্দ করেন। (অগ্রপথিক, ইফাবা-১৯৯৮, পৃ. ১২৮)

পাকিস্তান আমলে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড স্বায়ত্তশাসিত ছিল না। ইসলামি শিক্ষা সম্প্রসারণ ও ইসলামি আকীদাভিত্তিক জীবন গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে এর পুনর্গঠন করেন। নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড’।
হজ্জ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “মানুষের উপর আল্লাহর এ অধিকার আছে, যে এ ঘরে পৌঁছার ক্ষমতা রাখে সে যেন হজ্জ করে।’’ (আলে ইমরান: ৯৭) পাকিস্তান আমলে হজ্জ যাত্রীদের জন্য সরকারি কোনো অনুদান দেওয়া হতো না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম হজ্জ যাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন। (বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, পৃ. ১৭৪) শুধু তাই নয় বাংলাদেশের হাজ্বীগণ স্বল্প খরচে সমুদ্রপথে যাতে হজ্জ করতে পারেন সে জন্য তিনি ‘হিজবুল বাহার’ নামে একটি জাহাজ ক্রয় করেন। (শামীম মোহাম্মদ আফজাল, শেখ হাসিনার প্রেরণায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা: ইফাবা, ২০১৭, পৃ. ২৬)

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হাক্কানী আলেম উলামাদের সংগঠিত করে মহানবী (সা.) এর জীবন ও কর্ম জনগণের মাঝে তুলে ধরার জন্যে বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ সীরাত মজলিশ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে মাহে রবিউল আউয়ালে বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্তরে রাসূল (সা.) এর জীবনীর উপর বৃহত্তর আঙ্গিকে জাতীয়ভাবে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ মাহফিলের উদ্বোধন করেন। (বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, পৃ. ১৭৩)

বেতার ও টিভিতে কোরআন তেলাওয়াত ও তাফসীর প্রচারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং সর্বপ্রথম বেতার ও টিভিতে সকালের সূচনা এবং দিবসের কর্মসূচি তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাপ্ত করার নির্দেশ প্রদান করেন। (বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, পৃ. ১৭৩)বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বক্তৃতা শেষে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করেন। এ মুনাজাত স্বাধীনতা ও তার নিরাপদে দেশে ফেরার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ মুনাজাত। সৃষ্টিকর্তার কাছে তিনি ধন্যবাদ জানানোর জন্য এ মুনাজাত করেছিলেন। এতে তার ধর্মীয় চেতনার প্রকাশঘটে।

পাকিস্তান আমলে ইসলামি দিবসসমূহে সরকারি ছুটির ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই সর্বপ্রথম ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), শব-ই-কদর, শব-ই-বরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটির ব্যবস্থা করেন। যথাযোগ্য মর্যাদায় ধর্মীয় দিবসসমূহ পালনের উদ্দেশ্যে সিনামা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ( বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, পৃ. ১৭৩)বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ঙওঈ) এর অধিবেশনে যোগ দিয়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে যে বক্তব্য প্রদান করেন, তাতে আরব বিশ্বসহ মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।

ইসলামে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বৈধ হলেও পাকিস্তান আমলে রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার নামে জুয়া, হাউজি ও বাজি ধরার প্রতিযোগিতা চলতো। বঙ্গবন্ধু এটি বন্ধ করে সেখানে গাছ লাগানের ব্যবস্থা করেন। কারণ মহানবী (সা.) বলেন, “আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যদি কোনো মুসলিম কোনো গাছ রোপন করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে আর তা থেকে কোনো পাখি, মানুষ বা চতুস্পদ প্রাণী খায়, তবে তা তার জন্য সাদকা হিসেব গণ্য হবে।” (সহীহ বুখারী-২৩২০) তিনি বৃক্ষরোপন করে এ মাঠের নামকরণ করেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। (বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম পৃ. ১৭৪-১৭৫) ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন করেন এবং সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন। তিনি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে ১ লক্ষ পাউন্ড চা, ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিমসহ একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রেরণ করেন। এ সমস্ত মৌলিক কার্যাবলীর মাধ্যম তাঁর ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রকাশ পায়। ধর্মের প্রতি কতটা গভীর অনুরাগ থাকলে সাংবিধানিক কাঠামোর বাহিরে এসে তিনি ধর্মীয় চেতনা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

আল্লাহ তায়ালা মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপকে হারাম করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,“হে ঐসব লোক, যারা ঈমান এনেছ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, পূজার বেদি ও কিসমত তালাশ করার তীর নাপাক শয়তানী কাজ। এসব থেকে দূরে থাক, যাকে তোমরা সফল হতে পার। অবশ্যই শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে দুশমনী ও হিংসার জন্ম দিতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর যিকর ও নামাজ থেকে ফিরিয়ে রাখতে চায়। অতএব তোমরা কি এসব থেকে বিরত থাকবে?” (আল-মায়িদাহ: ৯০-৯১) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, “যিনার ধারে কাছেও তোমরা যেও না। নিশ্চয়ই তা বেহায়াপনা ও বড়ই মন্দ পথ।’’ (বনী ইসরাঈল: ৩২) সুতরাং বলা যায় বঙ্গবন্ধুর ধ্যাণ ধারনায় ধর্মীয় চেতনা জাগরুক ছিল। ইসলামের নামে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে অবাধে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলতো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে শাস্তির বিধান করেন। (বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, পৃ. ১৭৪) এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের প্রকাশঘটে।

ইসলাম আল্লাহ তায়ালার মনোনীত একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের উপর চলার জন্য জ্ঞান অর্জন প্রয়োজন। ইসলামের যথার্থ শিক্ষা ও মর্মবাণী সঠিকভাবে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচার ও প্রসারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান বাহিনীর সাথে আঁতাতের অভিযোগে নিষিদ্ধ হওয়া ইসলামিক একাডেমি পুণরায় চালু করেন। ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ নামকরণ করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন। কুরআন ও সুন্নাহর প্রচার ও প্রসার কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যেগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এক অধ্যাদেশ জারি করে এই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামী আদর্শের যথাযথ প্রকাশ তথা ইসলামের উদার মানবতাবাদী চেতনা বিকাশের লক্ষ্যে একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা ছিল বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফসল।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ্যাক্টে প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয় তা হচ্ছেÑ
ক. মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্র, একাডেমী ও ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা ও রক্ষাণাবেক্ষণ করা।
খ. মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্র, একাডেমী ও ইনস্টিটিউট এবং সমাজ সেবায় নিবেদিত সংগঠনসমূহকে আর্থিক সহায়তা দেয়া।

গ. সংস্কৃতি, চিন্তা, বিজ্ঞান ও সভ্যতার ক্ষেত্রে ইসলামের অবদানের উপর গবেষণা পরিচালনা।
ঘ. ইসলামের মৌলিক আদর্শ বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ, পরমতসহিতা, ন্যায়বিচার প্রভৃতি প্রচার করা ও প্রচারের কাজে সহায়তা করা এবং সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামি মূল্যবোধ ও নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করা।

ঙ. ইসলামি মূল্যবোধ ও নীতিমালা জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, ইসলামি সাহিত্য সুলভে প্রকাশ করা এবং সেগুলোর সুলভ প্রকাশনা ও বিলিবণ্টনকে উৎসাহিত করা।

চ. ইসলাম ও ইসলামের বিষয় সম্পর্কিত বই-পুস্তক, সাময়িকী ও প্রচার পুস্তিকার অনুবাদ করা, সংকলন করা ও প্রকাশ করা।

ছ. ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আইন ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিষয়াদির উপর সম্মেলন, বক্তৃতামালা, বিতর্ক ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা।
জ. ইসলাম বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য পুরস্কার ও পদক প্রবর্তন করা।
ঝ. ইসলাম সম্পর্কিত প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া, প্রকল্প গ্রহণ করা কিংবা তাতে সহায়তা করা।
ঞ. ইসলাম বিষয়ক গবেষণার জন্য বৃত্তি প্রদান করা।
ট. বায়তুল মোকাররম মসজিদের ব্যবস্থাপনা ও উন্নতি সাধন করা।
ঠ. উপরিউক্ত কার্যাবলির যেকোনটির ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক কাজ সম্পাদনা করা। (বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম, পৃ. ১৭২-১৭৩)

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শিক্ষা আসলে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বরে করে দেয়নি, তাদের সাথে ভালো ব্যবহার ও ইনসাফ করতে আল্লাহ নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে পছন্দ করেন।” (মুমতাহিনা: ৮) ভিন্ন ধর্মের মানুষদের সাথে মুহাম্মদ (সা.) সহানুভ‚তিশীল ব্যবহার করতেন এবং সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। ভিন্ন ধর্মের কোনো প্রতিবেশী অসুস্থ হলে তিনি তাদের দেখতে যেতেন এবং তার মাথার কাছে যেয়ে বসতেন। (আবূ দাউদ-৩০৯৭) সায়্যিদ আমীর আলী বলেন, “যখন বিশ্বের অর্ধেক জুড়ে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল, মুসলিম শাসক ও গভর্নরগণ মুসলিম সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তাদের ধর্ম অনুযায়ী উপাসনা করার পূর্ণ অধিকার প্রদান করেছিলেন।” (ঞযব ঝঢ়রৎরঃ ড়ভ ওংষধস, ঢ়. ২১২) খলিফা উমর (রা.) সফল ধর্মের মানুষকে সহানুভ‚তির চোখে দেখতেন। সংখ্যালঘুরা জিযিয়া কর দিয়ে নিরাপত্তা লাভ করতেন। খলিফা যদি তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হতেন তবে তাদের কর ফেরত দিতেন। যুদ্ধের শুরুতে উপাসনালয়, গির্জা, শিশু, বৃদ্ধা ইত্যাদির উপর আক্রমণ করতে নিষেধ করতেন। (অধ্যাপক কে. আলী, ইসলামের ইতিহাস, পৃ. ১৭৭) স্বাধীনতাত্তোরকালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করেন। তখন এদেশের জনগণের শতকরা ৮৬.৬০ ভাগ মুসলমান, ১২.১ ভাগ হিন্দু, ০.৬ ভাগ বৌদ্ধ এবং ০.৩ ভাগ খ্রিস্টান ও অন্যান্য উপজাতি সম্প্রায় বসবাস করতো। (বাংলাদেশের অর্থনীতি, পৃ ৫০) বঙ্গবদ্ধু ১৯৭২ সালে সংবিধানে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সব শ্রেণির নাগরিকের জন্য সমঅধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান) কারণ একটা রাষ্ট্রে বহু ধর্মের লোক থাকবে কিন্তÍ রাষ্ট্রতো সকলের। রাষ্ট্রদর্শনের এ সহজপাঠ তিনি ধর্মের মৌলিক শিক্ষার মত অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। যেমন রাসূল (সা.) মদীনা সনদে দেখিয়েছিলেন। মদীনার সনদে রাসূল (সা.) বিভিন্ন গোত্রকে সাথে নিয়ে মদীনার সংবিধান তৈরী করেছিলেন। যেমন: আউস গোত্র, খাযরাজ গোত্র, বনি মোস্তালিক ও বনিয়ামিন প্রমুখ গোত্র।

বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য স্মরণীয় ভাষণ রয়েছে। এ ভাষণসমূহের মধ্যে আমরা ইসলামি ভাবধারা পরিলক্ষিত হতে দেখি। কয়েকটি ভাষণের উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হলো:
ক. ১৯৭০ সালের নভেম্বরে বেতার ভাষণে বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থ ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান, মুসলমান ধর্ম পালন করবে। হিন্দু, হিন্দুর ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান, খ্রিস্টানের ধর্ম পালন করবে। কেউ কাউকে বাধা দিবার উচিত না, দিতে পারবে না।”

খ. ৭ মার্চ ১৯৭১: “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।” কোন কাজের সংকল্প করে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলতে হয়, এটা ইসলামী সংস্কৃতি। ‘ইনশাআল্লাহ’ অর্থ যদি আল্লাহ তায়ালা চান। এখানে ইসলামের মৌলিক বিশ^াস জড়িত। আর তাহল কোন মানুষ নিশ্চিত করে বলতে পারেনা আগামী দিন সে বাঁচবে। আল্লাহ তায়ালা যে কোন সময় তার মৃতে্যূ দিতে পারেন। জীবন -মৃতে্যূর মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা। সুতরাং ভবিষ্যতে কোন কিছু করার ইচ্ছা বা ঘোষনা দিলে বলতে হয় ‘ইনশাআল্লাহ’ মানে যদি আল্লাহ চাহেন। রাসূল (সা.) ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলায় তাঁর কাছে কিছুদিন ‘অহী’ আসা বন্ধ ছিল। তাঁর ভাষণের এ সকল উক্তি দ্বারা তাঁর দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ, মানবতাবোধ, ঈমানী চেতনা ও আল্লাহর উপর অগাধ ভরসার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় এবং বুঝা যায় তার ঈমানী শক্তি কত মজবুত ছিল।

বঙ্গবন্ধু শৈশব থেকেই ধর্মীয় চেতনায় লালিত পালিত হয়েই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, অসহায়দের সাহায্য করা ও অধিকার বঞ্চিত বাঙ্গালির জন্য সমূহ ত্যাগ স্বীকার করার দীক্ষা নিয়েছেন। প্রথমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা এবং পরে সেই পাকিস্তানের শোষণের বিরোদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের সময়কালেও তিনি ইসলামী চেতনা ধারণ করতেন। ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় অনুশাসন তিনি মেনে চলতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে তিনি যে ইসলামের বিপুল খেদমত করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থাকার পরেও মুজিব ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের মাধ্যমে ইসলামী অনুশাসনের প্রতি অগ্রসর হন। ইসলামী গোত্রগুলোর জোর দাবীর প্রেক্ষিতে এ্যালকোহল তৈরী ও বিপনন এবং জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করেন। ‘বাংলাদেশ অরগানাইজেশন অব দি ইসলামিক কনফারেন্স’ এবং ‘ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের’ সদস্যপদ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে যান; যা মুসলিম বিশে^র রাষ্ট্রসমুহের সাথে কিছু মাত্রায় সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়তা করে। শেষ বছরগুলোতে তিনি তার স্বভাব সুলভ জয় বাংলা অভিবাদনের বদলে ধার্মিক মুসলমানদের পছন্দনীয় ‘খোদা হাফেজ’ বলতেন। জনসাধরণের সামনে উপস্থিতি ও ভাষণের সময় তিনি ইসলামিক সম্ভাষণ ও শ্লোগান বাড়িয়ে দেন এবং ইসলামিক আদর্শের উল্লেখ করতে থাকেন। এ সবকিছু বঙ্গবন্ধুর জীবনে ইসলামী চেতনাবোধের প্রমাণ বহন করে। যা তাঁর জীবনে ইসলামী মূল্যবোধেরই বহিঃপ্রকাশ; ইসলামের খেদমাতে তার অবদান। আল্লাহ তায়ালা তাকে জাযায়ে খায়ের দান করুক। আমীন।

 

মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ
পিএইচডি গবেষক
ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ
(আইবিএস)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

আরো পড়ুন