দরকারী মানুষের সন্ধানে

আগামীর বাংলাদেশ ও নেতৃত্বের নতুন সংজ্ঞা
মনোয়ার হোসেন রতন ।।
ইতিহাস মানুষের হাত ধরে এগিয়ে যায়, তবে গন্তব্য নির্ধারণ করে নেতৃত্ব। নেতৃত্ব যদি দূরদর্শী, নীতিবান, এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন না হয়, তবে জাতির অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্র তাদের সঠিক নেতৃত্বের কারণেই একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে পেরেছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে এ বিষয়ে অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন।
১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা লাভের পর নবজাত আমেরিকা রাষ্ট্রকে একটি কার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থায় রূপান্তর করা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। ভিন্নমত, বিভাজন এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও ওয়াশিংটন জানতেন, কেবলমাত্র ঐক্য এবং সহনশীলতার ভিত্তিতেই একটি নতুন রাষ্ট্রের ভিত শক্ত করা সম্ভব। এজন্যই তিনি তাঁর মন্ত্রিসভায় একদিকে ধনতন্ত্রের প্রবক্তা ও রক্ষণশীল অর্থনৈতিক চিন্তার ধারক আলেকজান্ডার হ্যামিলটনকে আর্থিক নীতির দায়িত্বে রেখেছিলেন, অপরদিকে গণতন্ত্রের প্রবক্তা ও কৃষিভিত্তিক সমাজের পক্ষসমর্থক টমাস জেফারসনকে দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র বিভাগের দায়িত্ব। এই দ্বৈত চিন্তাধারাকে এক টেবিলে বসিয়ে সমন্বয় করেছিলেন রাষ্ট্রের কল্যাণে।
এটিই ‘দরকারী মানুষ’ হওয়ার নির্যাস—যিনি ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, জনমানুষের সঙ্গে সংযুক্ত এবং জাতীয় স্বার্থকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেন।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দরকারী নেতার প্রতিচ্ছবি
আধুনিক সময়েও এমন উদাহরণ দেখা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদের দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলেন, তখন প্রতিশোধের রাজনীতি বেছে না নিয়ে তিনি গঠন করেছিলেন ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’—একটি জাতিগত পুনর্মিলনের পথে হাঁটার দৃঢ় সাহসিকতা। আবার জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, যিনি যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিক রাজনীতির মডেল হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত হয়েছেন, তাঁর নেতৃত্বে জার্মানি শুধু ইউরোপ নয়, গোটা পৃথিবীর দৃষ্টিতে স্থিতিশীল নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নেতৃত্বের সংকট ও দরকারী মানুষের অভাব
বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দলীয় বিভাজন, প্রতিহিংসা, এবং সহনশীলতার ঘাটতির কারণে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক গতিপথে অগ্রসর হতে পারেনি। অনেক সময় নেতৃত্ব কেবল দলকে টিকিয়ে রাখার রাজনীতি করেই ব্যস্ত থেকেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শক্তিশালী বিরোধী দল, কার্যকর প্রতিষ্ঠান এবং জাতিগত-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নেতৃত্বের ঘাটতি আমাদের গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে।
একটি দেশ কেবল উন্নয়ন প্রকল্প দিয়ে নয়, নেতৃত্বের নৈতিকতা, জনসচেতনতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা গঠনের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে উন্নত হয়। তাই আগামীর বাংলাদেশে প্রয়োজন ‘দরকারী নেতৃত্ব’—যে নিজের মতবাদে অটল থাকলেও বিরোধী মতকে শত্রু নয়, সহযোগী হিসেবে দেখবে। যিনি রাজনৈতিক স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন, যিনি সংকীর্ণতা, ধর্মান্ধতা, ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাজন নয় বরং সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী জাতিসত্তা গড়ার স্বপ্ন দেখাবেন।
‘দরকারী মানুষ’ কেমন হবেন?
১. নৈতিক সাহস ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি: যিনি উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখবেন।
২. ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল: বিরোধীপক্ষকে দমন নয়, বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অংশ হিসেবে মূল্যায়ন করবেন।
৩. প্রযুক্তি ও তথ্য-নির্ভর চিন্তায় দক্ষ: চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে নেতৃত্বকে হতে হবে উদ্ভাবনী।
৪. মানবিক ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন: দেশের মানুষের দুঃখ-বেদনা নিজের জীবনের অংশ মনে করেন এমন কেউ।
৫. সুশাসনের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়ন: জনপ্রশাসনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হবেন।
৬. অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণকারী: ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা তৈরি করতে সক্ষম।
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস বলছে, উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব। আগামীর বাংলাদেশকে যদি সত্যিই একটি উন্নত, গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তবে আমাদের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে সেই ‘দরকারী মানুষ’-কে—যিনি হবেন জর্জ ওয়াশিংটনের মতো ঐক্যদর্শী, এখানে উল্লেখ্য যে, জর্জ ওয়াশিংটনকে বলা হতো ‘দরকারি মানুষ।’ ম্যান্ডেলার মতো ক্ষমাশীল, আর মার্কেলের মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।
এগিয়ে যাওয়ার পথে নেতৃত্বের পরিবর্তনই হতে পারে সবচেয়ে বড় বিপ্লব।
