ঐতিহাসিক পদ্মবিলে ফুটন্ত পদ্ম
আরো পড়ুন:
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনুপম আধার, নামটি তার পদ্মবিল। ঋতুচক্রের লীলাভূমি এই বাংলাদেশে বর্ষার শেষার্ধেই আগমণ ঘটে শরৎ ঋতুর। সময়টাও অনেকটা বর্ষাকালের সাথেই হয়ে থাকে তূল্য। ঠিক তখনই অপার শোভাবর্ধন করেই চলে অবিরত-অহর্ণিশ। এর অবস্থান বাংলাদেশ আর ভারতের সীমান্ত ঘেষা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাতেই ঐতিহ্যবাহী আর নান্দনিক বিলটি অবস্থিত। জেলার কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়ন এলাকায়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে এঁকে বেঁকে নেমে এসেছে খরস্রোতা ‘সিনাই’ নদী। পূর্ব থেকে পশ্চিমে গোপীনাথপুর ইউনিয়নের বুক চিড়ে বয়ে গেছে সর্পিলাকৃতিতে। ভারত থেকে নামার কিছুদূর পার হবার পরই সৈয়দপুর এলাকায় সিনাই নদীর উত্তর দিকটায় দৃষ্টিকাড়া পদ্মবিলের অবস্থান। ঐতিহ্যমণ্ডিত পদ্মবিল এলাকায় একদা জন্মেছিলাম, তাই নিজেকে অনেকটা গর্বিত সন্তান বলেই মনে করি। পদ্মবিলের পশ্চিম দিকে পাহাড়ময় গ্রামগুলোরই একটি জগন্নাথপুর। পাহাড়িয়া সেই গ্রামটিতেই হয়েছিলো আমার জন্ম। সঙ্গতেই পদ্ম বিলের অনেকটা পরশ-মায়া-ভালোবাসাতেই হয়েছিলো আমার বেড়ে ওঠা। এখন যদিওবা সেইসব স্মৃতিময়তা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ঐতিহাসিক এই পদ্মবিলের অবস্থান নানাবিধ কারণেই অত্যন্ত বৈচিত্রমণ্ডিত। একেতো এটি পৃথক দু’টি দেশের মিলনস্থলে,তদুপরি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলারও পৃথক দু’টি উপজেলার মিলনস্থলে এর অবস্থান। পদ্মবিলের উত্তর দিকে আখাউড়া উপজেলা। এই উপজেলার মনিয়ন্ধ ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী ঘাগুটিয়া গ্রামটি পদ্মবিলের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। আবার বিলটির দক্ষিণ প্রান্তে আরেক উপজেলা, কসবা।এই কসবা উপজেলার সীমান্তবর্তী দৌলতপুর গ্রামটি পদ্মবিলের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত। আর পদ্মবিলের পূর্ব প্রান্তে তো আরেকটি দেশ-ই অবস্থিত। ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা জেলার আমতলী থানা এলাকাধীন মাধবপুর নামের গ্রামটি অবস্থিত নয়নাভিরাম পদ্ম বিলের একেবারেই পূর্বপ্রান্তে। দালিলিকভাবে ঐতিহ্যের পদ্মবিল সৈয়দপুর, দৌলতপুর, ভোল্লাবাড়ি এবং ঘাগুটিয়া এই চার মৌজায় অবস্থিত। তন্মধ্যে কেবল দৌলতপুরের অংশেই বিলটির অন্তত ৪০ ভাগ। সৈয়দপুর এবং ভোল্লাবাড়ি মৌজায় ৫০ আর অবশিষ্টাংশ ঘাগুটিয়া মৌজাস্থিত। উল্লেখিত চারটি গ্রামের মধ্যে কেবল ঘাগুটিয়া গ্রামটিই আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্ধ ইউনিয়ন এলাকায় অবস্থিত।অপর তিনটি গ্রামই অবস্থিত কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়ন এলাকায়। তবে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ঘাগুটিয়া দিয়ে সহজতর বিধায় অনেকেই পদ্মবিলকে আখাউড়া এলাকার বলেই মনে করে থাকেন।
ষড়ঋতুর এক অনন্য কাল শরৎ। ভাদ্র আর আশ্বিণ, এই দু’মাস শরৎকাল। ওই সময়টাতে প্রকৃতি আরেক অনন্য সাজে হয় সজ্জিত। এটাই চিরায়ত বাংলা তথা অাবহমান বাংলার অারেক রেওয়াজ বটে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে পানিতেও দেখা মেলে নয়নাভিরাম রূপ। শাপলা-পদ্ম এসবেরই অংশবিশেষ। পদ্মবিলে আশ্বিণে ফুটে মন মাতানো আর দৃষ্টিনন্দন পদ্ম। সেসময়ে গোটা এলাকাটিই হয়ে ওঠে নয়নাভিরাম দৃশ্যমণ্ডিত। অত্যন্ত মনোলোভা রঙ আর অপরূপ সৌন্দর্যে সকলকেই মুগ্ধ করে তুলে পদ্মবিলের পদ্ম। আজকাল অবশ্য দেশের দূর-দূরান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থীও আসেন প্রকৃতির লীলাময় পদ্মবিলের অপার মায়াময় সৌন্দর্য উপভোগ করতে। পদ্মবিলে ফোটা পদ্ম স্থানীয়ভাবে ‘পইট ফুল’ হিসেবেও সমধিক পরিচিত। এই বিলটিকে একদা বলা হতো ‘পইট পাতার বিল’। তৎসময় এই পদ্ম পাতা তথা পইট পাতারও ছিলো অনেক কদর। জলে ভাসা পদ্ম পাতার অর্থনৈতিক মূল্যও ছিলো অত্যন্ত অধিকতর। কেননা, হাট-বাজার-বন্দরে নিত্যপণ্য লবণ-গুড় হতো ক্রয়-বিক্রয়। আর এই দু’টি পণ্যের প্যাকেট/পোটলা করার অন্যতম উপকরণই ছিলো পইট পাতা। ছোট ছোট নৌকায় করে পইট পাতা সংগ্রহ করতো পার্শ্ববর্তী বিনাউটি ইউনিয়নের রাউৎহাট গ্রামের রিষি সম্প্রদায়ের লোকেরা। সেসব কথা আজ এখানে নাইবা বললাম।
মানুষ মাত্রেই সুন্দরের পূজারি। ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক, ভালোবাসার প্রতীকও বটে। ফুলকে ভালোবাসেন না এই ধরাধামে এমন কেউ কি আছেন? এমনটি অন্তত আমার অজানা। ফুল সকলেরই প্রিয়, আর সেইটি যদি হয় জলে ফোটা পদ্ম! তবেতো নিশ্চয়ই আরো অনেক মনোহর। জলে ভাসমান সবুজ পত্রের মাঝখানে ফুটন্ত পদ্ম দেখতে কারই-না ভালো লাগে! তাছাড়াও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার পূজার্চনার অন্যতম উপকরণই হচ্ছে পদ্ম ফুল। পদ্মবিহনে হয়না হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেবী দুর্গার আরতি-হয়না দেবীর পূজা। হিন্দুদের সর্ববৃহৎ ধর্মানুষ্ঠান হচ্ছে শারদীয় দুর্গা পূজা। বিশেষত শরৎকালেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এই পূজো। এজন্যই হয়তোবা ‘শারদীয়’ দুর্গা পূজা বলা হয়। আশ্বিণ মাসে পদ্ম ফুটে বিধায়ই হয়তোবা দেবী দুর্গার পূজাও এই আশ্বিণ মাসেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে! আশ্বিণ মাসে এই পদ্মবিল থেকে বাংলাদেশ-ভারতের মানুষেরা পদ্ম ফুল সংগ্রহ করে থাকেন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রিও হয় এই পদ্মবিলের পদ্ম ফুল। স্মরণাতীত কাল থেকেই এমনটি হয়েই আসছে। উভয় দেশের এতদাঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ধর্মকর্ম সমাপনের উপকরণ যুগিয়েই আসছে ঐতিহ্যমণ্ডিত এই পদ্মবিল।
এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, নির্বাহী সম্পাদক : দৈনিক প্রজাবন্ধু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।