পিআইবিতে মুগ্ধতার তিন দিন!

 

|| ইলিয়াছ হোসাইন ||
প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ। যাকে ছোট করে ডাকা হয় পিআইবি। ঢাকা শান্তিনগর সার্কিট হাউজ রোডে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার উন্নয়ন,,গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় অর্ধ শত বছর কাজ করছে। ২৯মে, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা। পিআইবির সেমিনার কক্ষে প্রবেশ করলাম। প্রশিক্ষকের আসনে বসা পাতলা গড়নের একজন পরিপাটি ব্যক্তি ড.জামিল খান। মোবাইল জার্নালিজমের উপর তিনি পিএইচডি করেছেন। গবেষণা করছেন এ বিষয়ের উপর। তাঁর সামনে বসা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বিভিন্ন মিডিয়ায় কাজ করা ২৮ জন তরুণ সাংবাদিক। মোবাইল জার্নালিজমের উপর প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। সূত্রমতে: আবেদনকারী ৩৬০জন সাংবাদিক থেকে বাছাই করে ২৮জনকে সুযোগ দেয়া হয়।
সবার উদ্দেশ্য প্রশিক্ষক প্রশ্ন ছুঁড়লেন মোবাইল সাংবাদিকতা কী? বহু রকমের উত্তর আসলো।

স্যার বক্তব্য দিলেন:মোবাইল দিয়ে সাংবাদিকতা করা মানেই মোবাইল জার্নালিজম নয়। যতো সম্ভব হালকা যন্ত্র ব্যবহার করে অন দ্যা স্পটে গিয়ে সেখান থেকে খুব দ্রুত এবং সহজভাবে খবর পাঠানোই হলো মোবাইল সাংবাদিকতা। সে যন্ত্র হতে পারে ছোট ক্যামেরা,অথবা মোবাইল ফোন। সহযোগী হিসেবে থাকবে প্রয়োজনীয় ডিভাইস, একুইপম্যান্ট এবং এপস।
চা পানের বিরতির পর ফের আলোচনা শুরু। মানুষ কি দেখবে,কোন এঙ্গেলে দেখতে ভালো লাগে। লং শট,মিড শট,ক্লোজ শট,ফেইস শট,এক্সট্রিম শট, অভার দ্যা সোলডার শট,নাকি ১৮০ডিগ্রি টু শটে। তা কতো রেশিওতে দেখতে স্বস্তি বোধ করে। ভার্টিকেল, হরিজেন্টাল নাকি ওয়ান ইস্টু ওয়ান রেশিওতে;গোল্ডেন কম্পোজিশন বা রুলস অব থার্ডে। এসব বিষয় নিয়ে এতো এতো গবেষণা হয়। এ প্রশিক্ষণে অংশ না নিলে কখনো তা অনুভব করতে পারতামনা। মজো২.০,মজো টু পয়েন্ট ওয়ান;নিউজ রুম এবং ইন্টারভিও ফ্রেমিংয়ে হেড রুম,ক্যামেরার গ্রিড লাইন। গল্প শোনালেন আধুনিক সাংবাদিকতায় আলজাজিরার গবেষণা,স্পিডি,মাল্টিটাস্কার,নিউজ দক্ষতা,হার্ডওয়ার্ক নিয়ে। উপমহাদেশের বিখ্যাত মোবাইল সাংবাদিক ভারতের উমা শঙ্করের স্টরি মেইকিং নিয়েও বললেন।

এর মধ্যে কক্ষে প্রবেশ করলেন জাফর ওয়াজেদ স্যার,মহাপরিচালক(পিআইবি)। সাংবাদিকদের নিকট যিনি একজন ইনসাইক্লোপিডিয়া হিসেবে পরিচিত।
সাংবাদিকতার দশ দিক নিয়ে যার মস্তিষ্ক সদা ব্যস্ত। তিনি কুমিল্লার সন্তান! বড় মজার বিষয় হচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক, পরিচালক(প্রশাসন)এবং প্রশিক্ষক কুমিল্লার। স্যার সবার সাথে পরিচিতি পর্ব সারলেন। সাংবাদিতা মহান পেশা। এ পেশার ধরণ হচ্ছে মানুষের সেবা। দিন দিন সাংবাদিকতার মান কমে যাচ্ছে,কারণ কি? এর প্রতিকার কি? তা প্রতিকারের দ্বায়ভার সাংবাদিকদেরই নেয়া উচিত। ফেইসবুকার,ইউটিউবার মানেই সাংবাদিক নয়,উভয়ের মাঝে পার্থক্য বুঝাতে হবে সাংবাদিককেই। শুধু ঘটনা ঘটলে নিউজ তৈরি করবেন এসব থেকে বের হয়ে আসেন। ব্যতিক্রমধর্মী স্টোরি খোঁজেন,খবর তৈরি করেন,যে স্টোরি জনসাধারণকে মুগ্ধ করবে। গুজব,মিসইনফরম্যাশন,ডিস ইনফরমেশন এ বিষয়গুলোর দিকে সাংবাদিকের গুরুত্ব দিতে হবে। চতুর্দিক নিয়ে জানতে হবে,পড়ালেখা করতে হবে,যাচাই-বাছাই করে তথ্য অন্বেষণ করতে হবে। সাংবাদিকরা বানান, উচ্চারণে ভুল করলে হবেনা;এতে গুরুত্ব দিতে হবে। মাইক্রোফোনে সাংবাদিকতার দশ দিগন্ত নিয়ে জাফর ওয়াজেদ স্যার অনর্গল বলেই গেলেন।

মধ্যাহ্ন বিরতি,২নং ভবনের দ্বিতীয় তলায়। সবাইকে আপ্যায়ন করছেন আমিরুল ইসলাম ভাই। গোপালগঞ্জের মানুষ। খুব বিনয়ী, ভদ্র। যার আতিথেয়তায় প্রশিক্ষণার্থীরা খুবই মুগ্ধ।
বিকেল ৩ টা। মাইক্রোফোন হাতে নিলেন প্রশিক্ষক মোহাম্মদ শাহআলম সৈকত। তিনি এ চলমান প্রশিক্ষণের সমান্বয়ক। কুমিল্লার হোমনার কৃতী সন্তান। হাসি-খুশি মজার মানুষ;বেশ আন্তরিকও বটে। কাজের প্রতি দ্বায়িত্বশীল, সময়ের প্রতিও বেশ সচেতন। প্রতিবেদনে কি লেখা যাবে,কি লেখা যাবেনা;সাংবাদিক তার লেখায় কি শব্দ পরিহার করবে;রিপোর্টিংয়ের বাক্য হবে ছোট ছোট;নিজের মন্তব্য দিয়ে সংবাদ সূচনা না করাই ভালো;কর্তৃবাচক দিয়ে বাক্য তৈরি করতে হবে। অল্প কথায় অনেক তথ্য প্রকাশের দক্ষতাসহ সাংবাদিকতায় কি করতে হবে;কি বর্জন করতে হবে সেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার মধ্য দিয়েই বিকেল ৫টায় ১ম দিনের সমাপ্তি হলো।

২নং ভবনের ৭এবং ৮তলায় প্রশিক্ষণার্থীদের থাকার বাসস্থান। রয়েছে ওয়াই-ফাই সুবিধা। প্রতি রুমে দু’জন। ভিআইপি এসি রুম গুলোতে ১ জন। সবকিছু মিলিয়ে থাকার পরিবেশ প্রশংসনীয়।
দ্বিতীয় দিনের ক্লাস,শাফাত রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিভাগ থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ করা তরুণ। কাজ করছেন বিভিন্ন নিউজ২৪ মিডিয়া হাউজে। মাঠে নেমে কাজ করা সাংবাদিক;কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন মাঠে নেমে,প্রশিক্ষণার্থীদের হাতে ধরে: ভিডিও এডিটিং,ইন্টারভিউ ফ্রেমিং,কম্পোজিশন,অডিও -ভিডিও সাউন্ড,বি রোল,বক্সপপ,ট্রানজিট শট,সিকোয়েন্স,বাইট,সিন্ক,ইনসার্টসহ মোবাইল জার্নালিজমের অপরিহার্য বিষয় নিয়ে। সর্বশেষ ১৪ জনের দুটি গ্রুপ করে দেখিয়েছেন কাইনমাস্টার,কেপকাট,ইনশটের এডিটিং খুঁটিনাটি বিষয়।
৭-৯টা পর্যন্ত আরেকটি প্রশিক্ষণ সুশাসন প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত অংশীজনের অবহিতকরণ কর্মশালা শুরু।
পরিচালক(প্রশাসন) জনাব জাকির হোসেন বক্তব্য রেখেছেন:সুশাসন,শুদ্ধাচার, তথ্য অধিকার আইন,এবং পিআইবির বিভিন্ন কর্মশালা-প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিয়ে।
শেষ দিনে দেয়ালে সমাপনের ব্যানার ঝুলানো। চেয়ারে বসে আছেন সবুজ রঙের টি শার্ট পরা তরুণ।
সাব্বির আহম্মেদ। বাংলাদেশ টাইমসের লিড সাংবাদিক। হাসি দিয়ে শুরু করলেন টেলিভিশন সাংবাদিকতা,ফেইসবুক পোস্ট করার সময়,মনিটাইজেশন,প্রোফাইল স্টেটাস ইত্যাদি নিয়ে।
এর মধ্যে ঢুকলেন বাংলাভিশনের৷ বার্তা সম্পাদক রুহুল আমিন রুশদ। আপাদমস্তক যার শুভ্রতায় আচ্ছন্ন। ক্লাস আয়োজন করলেন স্মার্ট বাংলাদেশ,তথ্য অধিকার আইন,সাংবাদিকদের নীতিমালা বিষয় নিয়ে। আমাদের নিয়ে গেলেন ২০৪১ সালে। কি হবে, কি করবে প্রযুক্তি। এআই তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের কতোদূর নিয়ে এসেছে,নিয়ে যাবে। ত্রিশ মিনিটে ভ্রমণ করিয়ে আনলেন ২৪-৪১’র ভবিষ্যৎ ।
তার মধ্যে ফুরিয়ে আসছে সময়। ঘন্টা পড়ছে বাড়ি যাবার। সমাপনী আড্ডা শেষ করবেন। প্রধান অতিথি আজকের পত্রিকার সহকারী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকার। সাংবাদিকতার অতীত বর্তমানের বহু দিক তুলে ধরেছেন। গুজব রিপোর্ট যে কতো বড় হাঙ্গামা তৈরি করতে পারে তেমন ঘটনা তুলে ধরেছেন।
বর্ণনা করেন: “মাছের বাজারে আগুন” এমন শিরোনাম দেখে এক কপি-পেস্ট অদক্ষ সাংবাদিক যাচাই-বাচাই না করে তিনি আগুন শব্দটাকে সত্যি সত্যি আগুন মনে করেন। সে সাথে রস-কষ দিয়ে বাড়িয়ে লিখেছেন আগুন লাগার ফলে মাছের বাজারপুড়ে ছাই, ক্ষয়ক্ষতিও বিপুল। কিন্তু দিন শেষে দেখা গেলো ঘটনাস্থলে কোনো আগুনের ঘটনাই ঘটেনি। আগুন দিয়ে মূল সাংবাদিক বুঝাতে চেয়েছেন দর বৃদ্ধি।
এ যে সাংবাদিকদের সরেজমিনে না যাওয়া। তথ্য যাচাই-বাচাই না করা। কপি-পেস্ট, অদক্ষ সাংবাদিকরাই জনগণকে বিপাকে ফেলছে। তবে এসবের দুনিয়া শেষ। সামনে যে প্লাটফর্ম আসছে তা হচ্ছে প্রতিযোগিতার মঞ্চ। এ মঞ্চে যে যতো মাল্টিটাস্কার সে ততো বেশি সফল। পেশাদার সাংবাদিককে,তাত্ত্বিক জ্ঞান, দক্ষতা,পরিশ্রম- মোবিলিটি,মাল্টিটাস্ক,এনসাইক্লোপিডিয়া এবং দেশের দশ দিক সম্পর্কে জানতে হবে। তাহলে একজন সাংবাদিক তার সহজ-সুন্দর-সাবলীল প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে জনগণের মাঝে আস্থা যোগাতে সক্ষম হবেন।
সব শেষ করে বুঝলাম প্রশিক্ষণ ছাড়া একজন সাংবাদিক প্রকৃতপক্ষে অপরিপক্ক-অপরিপূর্ণ, যতোই তিনি পরিশ্রমী হন না কেনো!
সবার প্রথমে ডাক পেলাম। সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে আলোকযন্ত্রে বন্দি হলাম। তারপর একটা গ্রুপ ছবি। হ্যান্ডশেইক করে সবাইকে জানালাম বিদায় সম্ভাষণ।
লেখক:অফিস রিপোর্টার,সাপ্তাহিক আমোদ।