আগুন থেকে খোলায়, খোলা থেকে আগুনে

মনোয়ার হোসেন রতন ।।
জলবায়ু শুধু প্রকৃতি নয়, মনুষ্যপ্রকৃতির ভেতরেও অস্থিরতা জাগায়। আর বাঙালি জাতি, সেই অস্থিরতার অনন্য প্রতিনিধি। একটা জাতি, যারা যুগ যুগ ধরে পতাকা উড়িয়েছে সংগ্রামের। অথচ ইতিহাসের পাতায় রেখে গেছে শুধু দুঃখের ছাপ। এ বাংলার আকাশে যতবার আলোর মিছিল উঠেছে, ততবারই পরবর্তী প্রহরে নেমে এসেছে নিঃসীম অন্ধকার।
‘ঐ ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে দাঁড়াবার সময় তো নাই!’
এ একেকটি পঙক্তি যেন আমাদের রাষ্ট্রনীতির প্রতিচ্ছবি। ক্ষমতার মসনদে বসে ব্যক্তিস্বার্থের বাগান চাষ করে যে সংস্কৃতি, সেখানে জনতার ভাগ্যে জোটে কেবল শূন্যতা আর প্রতারিত প্রতিশ্রুতি। আমরা আন্দোলনকে মহিমান্বিত করি, আবার সেই আন্দোলনের রক্তস্নাত পথ ভুলে যাই মুহূর্তেই। আজ মুক্তির গান গাই তো, কাল সেই গানেই বাঁধি শৃঙ্খল।
এমনকি, আমাদের প্রিয় মাটি, ‘শ্যামল ছায়ার পলিমাটি’ যেখানে প্রেম জন্ম নেয়, সেখানে আমরা ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে দিতে পারি না প্রাপ্য মর্যাদা। ‘আমরা ইতিহাস ভালোবাসি’ বললেও, আমরা সত্যিকারের ইতিহাসচ্যুত এক জাতি। আমরা শহীদের কথা বলি, অথচ তাদের রেখে যাওয়া স্বপ্ন বিকিয়ে দিই সিন্ডিকেটের কাছে।
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’—আমরা গাই, কিন্তু ভালবাসি কাদের জন্য? সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জন্য তো নয়! তাদের জন্য এ বাংলা বরাবরই ছিল শ্মশান। বাস্তবে আজও বাংলার মানুষকে খোলা থেকে আগুনে আর আগুন থেকে খোলায় লাফ দিতে হয়। কারণ, চারপাশে কেবল চাঁদাবাজি, দখল, দুর্নীতি আর দুঃশাসনের আধিপত্য।
বাঙালি জাতি যেন তামাশার চরিত্র হয়ে গেছে—স্মৃতি বিস্মৃত, বিশ্বাসভঙ্গ আর বিকৃত ইতিহাসের হিমশীতল আয়নায় আমরা নিজেদের মুখ দেখতে ভুলে গেছি। কোথাও আর স্বপ্ন নেই, কেবল ছেঁড়া পোস্টারে ‘বিক্রি হবে’ লেখা ভবিষ্যৎ।
যে দেশের প্রতিটি ইঞ্চি মাটিতে শহীদের রক্তের ছাপ, সেই দেশের রাজপথে আজ ভেসে বেড়ায় অনাস্থা, অবিশ্বাস, এবং এক গভীর অদৃশ্য মৃত্যু। ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’—শ্লোগানে শপথ নেওয়া প্রজন্ম আজ পেছনে হাঁটে, সামনে নয়। তাঁদের হাতে পতাকা নয়, মোবাইলের পর্দায় বিভ্রান্তি আর অসত্যের ফাঁদ।
এ বাস্তবতা আমাদের মুখে চপেটাঘাত করে বলে, সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: সামনে নতুন বিতর্ক, নতুন পদত্যাগ, নতুন পুনর্বাসন। একই খেলার নতুন রঙ। একরাশ শ্বাসরুদ্ধ অন্ধকার।
তবু আমরা আশা করি,
আবার কোনো একদিন ‘আগুনের পরশমণি’ ছোঁবে এ মাটি,
আবার কোনো একদিন শিকড় গজাবে ‘জয়যাত্রা’র বীজ।
যে  ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ হয়ে বয়ে যায় বুকের গভীর বেদনা, তার পাশে দাঁড়িয়ে একদিন আবার নতুন স্লোগানে ডাক উঠবে ‘আবার তোরা মানুষ হ!’
তখন হয়তো বাঙালির ভাগ্যে জুটবে—একফোঁটা সুখ, একটুখানি শান্তি।
তবে তার আগে চাই
সত্যকে সত্য বলা,
মিথ্যেকে ঘৃণা করা,
ক্ষমতার রথে নয়—
মানবতার পথে হাঁটা।
এ নিবন্ধ সংবিধিবদ্ধ এক সতর্কবাণী—আসন্ন সংকট কেবল অর্থনৈতিক নয়, নৈতিকতাজনিত;
এ সংকট বিবেকের, এ সংকট বেঁচে থাকার। তাই এখনই সময়—জেগে ওঠার। না হলে আমরা ইতিহাসে পরিচিত হবো
একটি নামহীন জাতি হিসেবে,
যাদের সব ছিল, অথচ কিছুই ছিল না।
inside post
আরো পড়ুন