আব্বার কাছে খোলা চিঠি

আশা করছি আম্মাকে নিয়ে ভালো আছেন। আপনার ইন্তেকালের ৩০ বছরের দিনে আমরা ৪ ভাইবোন মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী সংসদের সাথে একাত্ম হয়েছিলাম। সে এক অসাধারণ অনুভূতি আব্বা, আপনি জীবনে তা অনুভব করেননি। ড. আলী হোসেন চৌধুরী, ডা: ইকবাল আনোয়ার, নীতিশ সাহা, জহিরুল হক দুলাল ইনারা এখন আছেন আপনাদের আসনে। যুগের কি সুন্দর বিবর্তন। সংসদ কি চমৎকার অনুষ্ঠান করেছে আপনাকে নিয়ে। ওরা সকাল বেলায় আপনার কবর জেয়ারতের মধ্য নিয়ে দিনের কার্যক্রম শুরু করে সন্ধ্যায় আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে শেষ করে।
এবছর সংসদ কুমিল্লার ভিক্টোরিয়াসহ অন্যান্য কলেজের বেশ কিছু ছাত্র ছাত্রীদেরও দাওয়াত করেছিল; উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্মকে কুমিল্লার অন্যতম পথিকৃৎ আমোদ সম্পর্কে জানার আরো সুযোগ করে দেয়া।
আমরা ভাইবোনেরা বলেছি আপনি কিভাবে পরিবার ভিত্তিক সংবাদপত্রের প্রবর্তন করলেন, দৈন্যতার মধ্য দিয়েও শাহেনশার মতন জীবন কিভাবে যাপন করেছেন।
ফজলে রাব্বী সংসদকে ব্যক্তিগত ভাবে ধন্যবাদ জানানোর আয়োজন করেছিল বড়পা তার একদিন আগে। আমোদের বার্ষিকীতে যেই চিন্তাধারায় আপনি অনুষ্ঠান সাজাতেন বড়পাও যেন আপনার সেই টেস্টকে অনুসরণ করেছেন। বড়পার মাঝে আমি আপনাকে দেখতে পাই আব্বা।
আপনি যেই কুমিল্লা দেখে গেছেন সেই কুমিল্লা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আজকের কুমিল্লা হলো উঁচু উঁচু বহুতল ভবনের কুমিল্লা, রিক্সা অটোরিক্সার কুমিল্লা আর ভয়ংকর রকমের ভাঙাচুরা রাস্তার কুমিল্লা। কিন্তু একটা জিনিস পরিবর্তন হয়নি বরং বেড়েছে, তা হলো কুমিল্লার মানুষের মায়া মমতা আতিথেয়তা।
এই প্রথম আমরা সবাই আপনার কবর জেয়ারত করতে পেরেছি কাছ থেকে। আম্মার কথা মনে হয়েছে তখন। আম্মার কবর আমরা নিজেরাই ঠিকঠাক করি, করতে হয় আর আপনার কবরের যতœ লোক দিয়ে করাতে হয়। তারপরও ছোটাপা হাত দিয়ে মাটিটা চারিদিকে ছড়িয়ে সুন্দর করে দিয়েছিল। বরাবরই সে তা করে আম্মার কাছে গেলেও।
হিমিকে দেখলে আপনি যে কত গর্বিত হতেন। আপনার অনেক আদর্শ দেখা যায় হিমির মধ্যে।
আব্বা, আমরা সবাই আলী চাচার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনিই শুধু বেঁচে আছেন এখন। কি যে খুশি হয়েছেন আমাদের সবাইকে এক সাথে দেখে। চাচার সেই দরাজ গলার আওয়াজ, আপনাকে অনেক মিস করেছি তখন। সবারই গাল বেয়ে তখন নোনা পানি পড়ছিলো, এমন কি চাচারও।
গত বছর ফুপুও বিদায় নিলেন দুনিয়া থেকে, ফুপুর বাসাটা কেমন খালি খালি লেগেছে আব্বা। ফুপাটাও নরম হয়ে গেছেন। আপনার লাইফ স্টাইলের অনেক কিছু দেখা যায় আবীরের মাঝে। মনে আছে আব্বা, ঢাকা যাওয়ার সময় আপনি ছোট ছোট তিনটা কৌটাতে কফি দুধ আর চিনি নিতেন। একটা ছোট চায়ের কাপ আর একটা চামচও থাকতো। দাউদকান্দি বা মেঘনা ফেরিঘাটে চা দোকান থেকে এক কাপ ফুটানো পানি নিয়ে নিজের কফি নিজে বানিয়ে খেতেন।
আবীরও উপরের তলায় বেডরুম গুলোর মাঝখানে যে সিটিং এরিয়াটা আছে, সেখানে ছোট ছোট ২/৩ টা কাঠের টুল আর একটা কাঠের টেবিল রেখেছে আর আছে ছোট্ট একটা চা বিস্কুটের ব্যবস্থা। এসব দেখলে আপনার কথা মনে হয়।
বড়দা, জামান ভাইয়ের শরীর ভালো যাচ্ছে না। জামান ভাইয়ের প্রথম কাজ ছিলো চাঁদপুরে। জয়েন করতে যাবে আমাদের বাসা থেকে, আপনি আম্মাকে বলেছিলেন পোলাও রোস্ট রান্না করে উনাকে খাওয়াতে, কারণ মা বেঁচে থাকলে তো তার ছোট ছেলের কাজের প্রথম দিনে ভালো মন্দ নিশ্চয়ই খাওয়াতো।
আমার স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির বন্ধু বান্ধবরা সবাই মিলেও অনেক মজা করেছি, অনেকেরই কথা – আমার লেখাটা আমার কবিতাটা আমোদ এ ছাপা হয়েছিল।
গত দুই আড়াই সপ্তাহ ঢাকা কুমিল্লা মিলিয়ে একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে চলে গেলো। ফিরে যাচ্ছি নীড়ে আবার। একটা প্রবাদ To raise a child, who is comfortable enough to live by themselves, means you have done your job. রিহামটা পুরো সময় বাসায় থেকে কাজ করেছে আমার অ্যাবসেন্সে। আর ওকে অ্যাসিস্ট করেছে জাস্টিন আর হিমি। আমার ভাগ্যের পাল্লা অনেক ভারী আব্বা আর কষ্টের পাল্লার ওজন কম হলেও ধার অনেক বেশি। হঠাৎ করে ধারালো ওই অস্ত্র যখন আঘাত করে সেই অনুভূতি প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই, শুধু চিৎকার করে কান্না করি কিছুক্ষণ। খুব ভালো হয়েছে চলে গিয়েছেন আপনি, সাথে আম্মাও। নইলে আমার কষ্ট আপনারা সহ্য করতে পারতেন না, কোনো পিতামাতাই পারতো না।
সবার সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার অপেক্ষায় আছি।
সব শেষে বলতে পারি, আপনি হয়তো বুঝতেও পারেননি আব্বা কতটা সার্থক ছিলো আপনার জীবন, যা আমরা বুঝেছি আপনার মৃত্যুর ৩০ বছর পর।
তারিকা রাব্বী
সাপ্তাহিক আমোদ সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বীর ছোট মেয়ে।

inside post
আরো পড়ুন