আমার শ্যামল বাংলা


মনোয়ার হোসেন রতন।।
আমার শ্যামল বাংলা—এই শব্দযুগল উচ্চারণেই হৃদয় কেঁপে ওঠে, চোখে ভেসে ওঠে এক সবুজ-স্নিগ্ধ ছবির রেখাচিত্র, যেখানে ধানক্ষেতের বাতাসে দুলে ওঠে সোনালি স্বপ্ন, সন্ধ্যার আকাশে পাখির ঝাঁক খেলে বেড়ায় আপন ছন্দে, আর মাটির সোঁদা গন্ধে মনে পড়ে যায় ফেলে আসা শৈশব। এই বাংলা শুধু আমার দেশের নাম নয়, এটা আমার অস্তিত্ব, আমার চেতনা, আমার ভালোবাসা। আমি যখন বলি “আমার বাংলা”, তখন সেটি শুধুই একটি মানচিত্র নয়—সেটি হলো এক সজীব অনুভব, যেখানে আমি প্রতিটি ধূলিকণায়, প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি ঢেউয়ে খুঁজে পাই এক বিশুদ্ধ মমতা।
আমার শ্যামল বাংলাকে যদি কেউ দেখতে চায়, তবে তাকে যেতে হবে গ্রামের পথ বেয়ে, কাঁচা রাস্তার দু’পাশে ছায়াঘেরা বট-অশ্বত্থ গাছের ছায়ায়, যেখানে বউ ঝিঁঝিঁর ডাক আর কোকিলের সুরে মিশে আছে প্রকৃতির সুরম্য গান। গ্রামের বুক চিরে বয়ে চলা ছোট নদীটি যেন জীবনধারার প্রতীক—জলশূন্য হলে যেমন মন খারাপ হয়, তেমনি টলমলে জলে মাছের ঝাঁক দেখলে বুক ভরে ওঠে আনন্দে। আর পুকুরের ঘাটে দাঁড়িয়ে জল ছোঁয়ার সেই অনুভূতি—তা কি আর কোনো শহুরে ফোয়ারা দিতে পারে?
বাংলা মানে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, এটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এক অসীম সম্ভার। মাটির উর্বরতা, কৃষকের ঘামে ফলানো ফসল, আর ঘরের উঠোনে দুধ-দই-ঘি, এসব মিলেই একদিন বাংলার প্রতিটি পরিবার ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেসময় শহরের দিকে তাকানোর তেমন প্রয়োজন ছিল না, কারণ নিজের গ্রামই ছিল এক স্বর্গভূমি।
ধানের গন্ধে ভরা গোলাঘর, শীতের সকালে গরম খেজুরের রস, কিংবা গাভীর দুধে ভরা কলস—এসব স্মৃতি শুধু খাদ্যাভ্যাস নয়, জীবনধারার প্রতিচ্ছবি। এই স্বয়ংসম্পূর্ণতাই ছিল বাংলার আত্মবিশ্বাস, বাংলার শক্তি।
শ্যামল বাংলার আরেক পরিচয় তার মানুষ। মুখে সহজ-সরল ভাষা, চোখে মায়া আর হৃদয়ে অশেষ অতিথিপরায়ণতা—এটাই গ্রামীণ বাংলার পরিচয়। বাংলার মানুষ কখনো নির্লজ্জভাবে প্রকৃতিকে ভোগ করেনি, বরং প্রকৃতির সঙ্গেই সহাবস্থানে গড়ে তুলেছে জীবনযাপন। তাই তো তুলসীতলার ধূপ, পুকুরপাড়ে সন্ধ্যার প্রার্থনা কিংবা মাঠে কৃষকের হাসি—এসবই মিলে এক অপূর্ব জীবনচিত্র।
কিন্তু এখন, সেই চিত্রটি খানিক বিবর্ণ। কংক্রিটের জঙ্গল, ইটের গরম, শব্দ দূষণ আর যান্ত্রিকতার নিচে চাপা পড়ে গেছে মাটির সোঁদা গন্ধ। আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের শেকড়, যে শেকড় আমাদের জুগিয়েছিল পরিচয়, সাহস, ভালোবাসা আর ঐতিহ্য। উন্নয়নের নামে আমরা হয়তো বহুতল ভবন বানিয়েছি, কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি উঠোনের পাঁকা আম, খেজুরগাছের ডাল, কিংবা পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া শৈশব।
তবে এখনও আশার আলো নিভে যায়নি। এখনও বাংলার বহু গ্রাম আঁকড়ে ধরে রেখেছে সেই পুরনো ছাঁদ, যেখানে প্রকৃতি, মানুষ ও সংস্কৃতি একসূত্রে বাঁধা। আমাদের দরকার শুধু সচেতনতা, দরকার প্রকৃতিকে ভালোবাসা, দরকার শিকড়ে ফিরে যাওয়ার মানসিকতা। শহরের আরাম আর চাকচিক্য হয়তো কিছু সুবিধা দেয়, কিন্তু জীবনের প্রকৃত শান্তি মেলে সেই প্রাকৃতিক আলিঙ্গনে, যেখানে মাটির ঘ্রাণে মিশে থাকে মা’র কোলের উষ্ণতা।
আমরা চাই, আবার গড়ে উঠুক সেই শ্যামল বাংলা—যেখানে শিশুরা ছুটে বেড়াবে সবুজ মাঠে, গরুর গাড়ির শব্দে মুখরিত হবে বিকেলের পথ, আর কৃষকের মুখে ফুটে উঠবে তৃপ্তির হাসি। আমরা চাই, আবার ঘরে ঘরে শোনা যাক লাঠি হাতে গরু চরানোর ডাক, উঠোনে বাজুক বাঁশির সুর, আর পুকুরে নেমে সাঁতার কাটুক কিশোরেরা।
বাংলা আমার অহংকার, বাংলা আমার প্রাণ। তাই আমি এই শ্যামল বাংলার কাছে ফিরে যেতে চাই, ফিরে যেতে চাই সেই পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধানের দিনে। ফিরে পেতে চাই সেই সহজ, সরল, সুন্দর জীবনযাপন যেখানে প্রকৃতি ছিল বন্ধু, খাদ্য ছিল নির্ভরযোগ্য, এবং জীবন ছিল পরিপূর্ণ।
আমার শ্যামল বাংলা—তুমি শুধু এক টুকরো ভূখণ্ড নও, তুমি আমার হৃদয়ের চিত্রপট, আমার অতীতের গল্প, বর্তমানের চিন্তা আর ভবিষ্যতের আশা। তোমার গায়ে মিশে আছে যতটুকু মাটি, প্রতিটুকু জল, ততটুকু ভালোবাসা দিয়ে আমি বলতে চাই—
তুমি আমার অহংকার, তুমি আমার চিরন্তন প্রেম।