আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গণরায়ের প্রত্যয়

আগামীর নির্বাচন—
মনোয়ার হোসেন রতন।।
বাংলাদেশ আজ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন—যা কেবল ক্ষমতা বদলের আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং হতে পারে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত প্রত্যয়ের সূচনা। এই নির্বাচন হতে হবে আধিপত্যবাদ ও রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে একটি গণজাগরণ।
আধিপত্যবাদ ও আমাদের রাজনীতি
একসময়কার মুক্তির সংগ্রাম আজ পরিণত হয়েছে দলীয় বলয়ের প্রতিযোগিতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণের খেলায়। অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীস্বার্থ, প্রশাসনে পক্ষপাত, বিচারব্যবস্থার প্রশ্নবিদ্ধতা এবং সংবিধানের চাতুর অপব্যবহার—সব মিলে রাষ্ট্রব্যবস্থা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এই বাস্তবতায় আধিপত্যবাদ কেবল বিদেশি প্রভাব নয়, বরং দেশের ভেতর থেকেই জন্ম নিয়েছে এক ধরনের ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র।
ফলে ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সমঅধিকার প্রশ্নবিদ্ধ। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি গণমুখী পরিবর্তন, যা জনগণের অধিকারকে কেন্দ্রে রাখবে, দলীয় স্বার্থ নয়।
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব—নতুন করে ভাবার সময়
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে স্বাধীনতা ও জাতিসত্তার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। উন্নয়নের নামে ঋণনির্ভরতা, চুক্তির আড়ালে নীতি নির্ধারণের স্বাধীনতা বিসর্জন এবং কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি—সব মিলিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব এখন এক প্রশ্নবিদ্ধ আলোচনার বিষয়।
এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনে জনরায় হতে হবে এমন নেতৃত্বের পক্ষে, যারা সাহসের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন এবং বৈদেশিক চাপের বাইরে গিয়ে দেশীয় জনগণের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন।
বৈষম্যহীন সমাজ—নতুন অভিযাত্রার শপথ
বাংলাদেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধির বাহারি গল্পের আড়ালে চাপা পড়ে থাকে সামাজিক বৈষম্যের নির্মম বাস্তবতা। শহর ও গ্রাম, ধনী ও দরিদ্র, ক্ষমতাবান ও প্রান্তিক মানুষের ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নাগরিক অধিকার আজ নির্ভর করছে পরিচয়, দলীয় সম্পর্ক বা পৃষ্ঠপোষকতার ওপর।
এই বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হলে আগামী নির্বাচন হতে হবে এমন একটি সমাজের জন্য রায়, যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও নিরাপত্তা হবে সবার অধিকার—কাউকে অনুগ্রহ নয়। প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যাঁরা সুবিধাভোগীদের মুখ চেয়ে নয়, নিচুস্তরের মানুষের পাশে থেকে তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ।
গণতন্ত্র হোক জনগণের মালিকানায়
নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মনোনয়ন বাণিজ্য, ভোট কারচুপি এবং প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকায়। তাই এবার প্রয়োজন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। এর জন্য চাই নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন প্রশাসন এবং ভোটারদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ।
গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয়, যখন জনগণ শুধু ভোট দেয়ার মাধ্যম নয়, বরং নীতিনির্ধারণে সক্রিয় ও কার্যকর শক্তি হয়ে ওঠে। এবারের নির্বাচন সেই শক্তির পুনরুদ্ধারের একটি ঐতিহাসিক সুযোগ।
আজ আমাদের দরকার নেতৃত্বের পরিবর্তনের পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন—যেখানে রাজনীতি হবে মানুষের কল্যাণে, আধিপত্যের বিরুদ্ধে এবং মানবিকতা ও সমতার পক্ষে। আগামীর বাংলাদেশ হোক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়ের পথে দৃপ্ত অভিযাত্রী। জনগণের রায় হোক সেই সত্যিকারের পরিবর্তনের পথচিহ্ন।
