অন্তরে অতৃপ্তি রবে

মনোয়ার হোসেন রতন।।
এই দেশ—এমন এক জীবনযাত্রার নাম, যেখানে প্রতিটি নিশ্বাসে জড়িয়ে থাকে দীর্ঘশ্বাস, আর প্রতিটি স্বপ্নের গায়ে লেগে থাকে বাস্তবের রক্তাক্ত দাগ। আমাদের সমাজে বাঁচার মানে কেবলই চলমান থাকা—প্রশান্তি নয়, পরিপূর্ণতা নয়, কেবলই এক অনন্ত অসন্তোষের সঙ্গে সহাবস্থান।
জীবন এখানে একেকটি ছোট ছোট দুঃখের কাহিনি। ক্ষুধা, অপমান, প্রত্যাখ্যান কিংবা স্বপ্নভঙ্গের ছোট ব্যথা একদিন একেকটি মহাকাব্যে রূপ নেয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, যেন “শেষ হইয়াও হইল না শেষ”—জীবনের গল্পটাও ঠিক তেমনই।
এ দেশের হৃদয়ে বাস করে এক নির্মম বিষাদ। নির্মলেন্দু গুণ যেমন বলেছিলেন, “আমি কখনো তোমাকে ভালোবাসিনি বলিনি তো, কিন্তু ভালোবাসি বলতেও পারিনি”—ঠিক তেমনি আমরা এই দেশকে ভালোবাসি, তবু প্রকাশ করতে পারি না। দেশকে ভালোবাসার মানে আজ প্রতিদিন নিজেকে হারিয়ে ফেলা। চারপাশে ভিড়ে গেছে সভ্যতার মুখোশে মুখোশধারী অসভ্যতা। আর সেই ভিড়ে দাঁড়িয়ে একজন সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে হয়।
এই দেশে জন্ম মানেই এক সংগ্রামের শুরু। মাথার উপর ছাদ নেই, পায়ের নিচে মাটি নেই, বুকের ভেতর নিশ্চয়তা নেই—তবু মানুষ হাসে, বাঁচে, স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্নগুলোই হয়তো একদিন সবচেয়ে বড় প্রতারণার রূপ নেয়। কেউ কেউ বলেন, এটিই বাঙালির সৌন্দর্য। কিন্তু আমি বলি, এ হলো আমাদের রক্তাক্ত পরিহাস।
মান্না দে’র কণ্ঠে শোনা যায়, “যে ক্ষতি আমি নিয়েছিলাম মেনে…”—এই দেশের মানুষও এমন ক্ষতির সঙ্গে জীবনের চুক্তি করে ফেলেছে। সমাজে কেউ ইতিহাসের নায়ক হতে চায়, কেউ স্বপ্ন দেখতে চায়, কিন্তু প্রতিবারই দৃশ্যপটে দেখা দেয় চক্রান্ত আর বিশ্বাসঘাতকতা। সিনেমার পর্দা থেকে ভেসে আসে নবাব সিরাজউদ্দৌলার কান্না, “বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা”—আর বাস্তব জীবনে তার প্রতিউত্তর হয় শুধুই নীরবতা।
এই দেশ যেন মুনীর চৌধুরীর নাটকের ট্র্যাজেডি, যেখানে জোহরার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, “আমি এত কষ্টের আগুনে পুড়ে… তোমাকে পাবার জন্য ছুটে এলাম— আর তুমি কিনা ঘুমিয়ে পড়লে!” এ সংলাপ শুধু নাটকের নয়, এ তো আমাদের মা, আমাদের প্রজন্ম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু এই ট্র্যাজেডিরও যেন কোনো গন্তব্য নেই। শেক্সপিয়রের ভাষায়, “A tale told by an idiot, full of sound and fury, signifying nothing.” আমরা শোরগোল করি, কিন্তু সে শোরগোলের কোনো মানে হয় না, কোনো ফল হয় না।
প্রকৃত দেশপ্রেমিকেরা, সমাজসংস্কারকেরা, চিন্তাবিদেরা—তাঁদের অনেকেই একসময় হারিয়ে যান। কেউ কারাগারে, কেউ নির্বাসনে, কেউ অবসাদে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। এদেশের জীবনের ব্যাকরণে অতৃপ্তিই যেন চূড়ান্ত পরিণতি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা বয়ে বেড়াই অসমাপ্ত গল্প, অপূর্ণ কবিতা, এক নিঃশেষ গান।
কারও প্রতিবাদ থাকে, কারও চিৎকার, কেউ চুপচাপ সহ্য করে, কেউবা মুখে হাসি রেখে সব গিলে ফেলে—তবু তৃপ্তি বলে কিছু নেই। হয়তো শেষটায় মনে হয়, “আমার এই পথ চাওয়াই ফুরালো, কোথাও কেউ নেই—শুধু আমি আর আমার ছায়া।”
এই জাতির হৃদয়ে জমে থাকে এক অনুচ্চারিত হাহাকার। বারবার মনে হয়, আমরা এক পরীক্ষা কক্ষে বসে আছি—ন্যায়, প্রেম, মানবতা আর স্বাধীনতার পরীক্ষায়। কিন্তু উত্তরপত্রে কেবল ভুলের পর ভুল, কাটাকাটির রেখা।
আমরা রক্ত দিয়ে ইতিহাস লিখেছি, কিন্তু তার ব্যাখ্যা অন্য কেউ লিখেছে। সেই বিকৃত ব্যাখ্যায় আমাদের আত্মপরিচয় হয়ে পড়েছে বিভ্রান্ত ও শিকড়হীন।
তবু এই দেশ কেবল একটি ভৌগোলিক সীমানা নয়, এটি এক সংগ্রামী আত্মার নাম—এক ভালোবাসা, যা চিঠি হয়ে পৌঁছায় না; গান হয়ে গলা ধরে আসে; কবিতা হয়ে তার শেষ চরণ আজও খুঁজে ফেরে।
এই দেশের মানুষ প্রতিদিন বাঁচে—অতৃপ্তি নিয়েও, কষ্ট নিয়ে, হাহাকার সঙ্গী করে। তবু তারা ভালোবাসে, তারা স্বপ্ন দেখে—কারণ এই অতৃপ্তিই তাদের বেঁচে থাকার এক অদ্ভুত শক্তি।
জীবনানন্দের মতোই তাই বলতে ইচ্ছা হয়— “আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয়, হয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে।”কারণ এই দেশের প্রতি ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না।
এমন এক দেশের ইতিহাসে, ভবিষ্যতে, প্রেমে ও প্রতিবাদে—অন্তরে অতৃপ্তি রবে…
inside post
আরো পড়ুন