আগুনের নেপথ্যে কারা?

inside post

দুর্ঘটনার আড়ালে ষড়যন্ত্রের গন্ধ স্পষ্ট

মন্তব্য প্রতিবেদন

মনোয়ার হোসেন রতন

বাংলাদেশ আজ যেন এক অদৃশ্য অগ্নিকুণ্ডের মধ্য দিয়ে পথ চলছে। শুধু স্থাপনা বা কারখানা নয়, একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে জ্বলছে আমাদের অর্থনীতি, শ্রমবাজার, বৈদেশিক বাণিজ্য, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তার ভিতও। সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে— মিরপুর, চট্টগ্রাম ইপিজেড ও সর্বশেষ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ড— সেগুলো নিছক দুর্ঘটনা বলে মেনে নেওয়া কঠিন।

এই আগুন কেবল আগুন নয় — এটি একটি বার্তা

১৮ অক্টোবর ২০২৫, দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকা — ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে দাহ্য রাসায়নিক ও পণ্যে ঠাসা গুদামে আগুন লাগে। একাধিক শেডে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস, বিমান ও নৌবাহিনীর সম্মিলিত প্রয়াসেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে, নষ্ট হয় কোটি টাকার রপ্তানিপণ্য, বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা টলে ওঠে।

এই ঘটনার মধ্যে কিছু গুরুতর প্রশ্ন জেগে ওঠে:

  • বিমানবন্দর এলাকার মতো উচ্চ সুরক্ষিত স্থানে দাহ্য পদার্থের গুদামে অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা কেন ছিল না?
  • প্রাথমিকভাবে আগুন শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে কেন ব্যর্থতা দেখা দিল?
  • এটি নিছক দুর্ঘটনা, না কি পরিকল্পিত আঘাত?

আমার বিশ্লেষণে এটি কেবল নিরাপত্তা ঘাটতির ফল নয়; বরং এটি একটি কৌশলগত আঘাত, যা সুপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

দুর্ঘটনা নাকি ধারাবাহিক নাশকতা?

বিমানবন্দরের আগুনের ঠিক আগেই:

  • চট্টগ্রাম ইপিজেডে ১৭ ঘণ্টার দীর্ঘ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় কোটি টাকার তৈরি পোশাক।
  • এর কিছুদিন আগে ঢাকার মিরপুরে একটি গার্মেন্টস কারখানা ও কেমিক্যাল গুদামে আগুনে নিহত হন ১৬ জন শ্রমিক।

এই তিনটি ঘটনায় একটি আশঙ্কাজনক মিল বিদ্যমান:

১. প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়।

২. প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অগ্নি নিরাপত্তা সনদ ছিল না, কিংবা তা ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ।

৩. প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ভয়াবহ দুর্বলতা ও অকার্যকারিতা দেখা গেছে।

যদি একটি দুর্ঘটনা ঘটে, তা দুর্ভাগ্যজনক। যদি তিনটি একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে, তা গুরুতর অবহেলা। কিন্তু যখন বারবার, অল্প সময়ের ব্যবধানে দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে একই ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে — তখন তা নিছক কাকতালীয় নয়, বরং ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করে।

এই অগ্নিকাণ্ডে কার লাভ?

প্রশ্ন ওঠে, এই অগ্নিকাণ্ডগুলো থেকে উপকৃত হচ্ছে কারা? আমার বিশ্লেষণে যেসব শক্তি সন্দেহের কেন্দ্রে:

১. শিল্পবিরোধী প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী, যারা বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ধ্বংস করে নিজেরা লাভবান হতে চায়।

২. রাজনৈতিক চক্রান্তকারী চক্র, যারা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়।

৩. বিদেশি বাণিজ্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী, যারা বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে দিতে চায়, যাতে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা অন্যত্র মুখ ফেরায়।

একটি বাস্তবতা হলো — বিমানবন্দরের কার্গো, ইপিজেড ও গার্মেন্টস খাতই দেশের অর্থনীতির তিনটি প্রধান স্তম্ভ। সেখানে বারবার অগ্নিকাণ্ড মানেই বৈদেশিক মুদ্রা, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগকে লক্ষ্য করে আঘাত হানা।

তদন্ত কমিটি, কিন্তু ফলাফল কোথায়?

প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরে আমরা শুনি— “তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে”। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ঘটে যাওয়া পঞ্চাশটিরও বেশি বড় অগ্নিকাণ্ডের কতটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে?
আর কতজন প্রকৃত দোষী শাস্তির আওতায় এসেছে? বাস্তবে দেখা যায়, আমরা তদন্ত নামক এক প্রথাগত আশ্বাসে বন্দী। এতে লাভ হয় দোষীদের, আর ক্ষতি হয় রাষ্ট্রের।

দায় এড়ানো যাবে না — অবহেলাই ষড়যন্ত্রকারীদের সুযোগ তৈরি করেছে

ধরা যাক, ষড়যন্ত্র সত্যি আছে। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র কার্যকর হলো কীভাবে?
আমাদেরই অব্যবস্থা, অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা তাদের হাতে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

কর্তৃপক্ষ, মালিক ও প্রশাসনের ব্যর্থতা:

  • নিয়মিত পরিদর্শন না করা
  • অগ্নি নিরাপত্তা সনদ ছাড়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনা
  • শ্রমিক নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করা
  • তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ না দেখা

এইসব অনিয়মের ফলে ষড়যন্ত্রকারীদের হাত খুলে গেছে।

সমাধানের পথ: মুখে নয়, বাস্তবে পদক্ষেপ জরুরি

বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আমি সুপারিশ করছি:

১. “জাতীয় অগ্নি নিরাপত্তা কমিশন” গঠন করতে হবে, যারা স্বাধীনভাবে তদন্ত করে প্রাপ্ত তথ্য জনগণের সামনে প্রকাশ করবে এবং প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেবে।
২. যেসব কারখানা বা স্থাপনায় অগ্নি নিরাপত্তা মানদণ্ড পূরণ হয়নি, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করতে হবে।
৩. ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধার বাহিনীগুলোকে উন্নত প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও সম্মানজনক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
৪. গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের মূল উৎস শনাক্ত ও নির্মূল করতে হবে।
৫. দোষীদের রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনতে হবে।

এখনই সময় জেগে ওঠার — নতুবা পুড়ে যাবে ভবিষ্যৎ

আমার কাছে এটি স্পষ্ট — বাংলাদেশের অর্থনীতির বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত আক্রমণ চালানো হচ্ছে। এই আক্রমণ শুধু গুদাম বা কারখানায় নয়, আমাদের ভবিষ্যতের ওপর।
যদি আমরা এখনই সতর্ক না হই, এই আগুন শুধু রপ্তানি নয়, আমাদের আত্মবিশ্বাস, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং জাতীয় সক্ষমতাকেও ভস্মীভূত করে ফেলবে।

দায়িত্বজ্ঞানহীনতার যুগ শেষ করতে হবে। এখন দরকার সাহসী সিদ্ধান্ত, বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে জবাবদিহি।
কারণ, এই আগুন নিছক অগ্নিকাণ্ড নয় — এটি জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও ভবিষ্যতের ওপর এক গভীর আঘাত।

লেখকের মতামত ব্যক্তিগত, তবে দেশের নিরাপত্তা, শ্রমিকের জীবন ও ভবিষ্যতের স্বার্থে এই প্রশ্ন সবার।

আরো পড়ুন