আলুর ভর্তা মেরুদণ্ডে!

 

মহিউদ্দিন মোল্লা।।
চলতি সময়ের কবিতার বই তেমন টানে না। একটু খেদ নিয়ে মোহাম্মদ রফিকের ভাষায় বললে- সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই! চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বইটি পড়তে বসেছি। ৮০ পৃষ্ঠার বই। উৎসর্গের পাতায় চমক। মাহের মিঞা ও স্বপ্নাহার বেগমের ছেলে সফিকুল ইসলাম। সফিকুল ইসলাম কবিতার বইটির উৎসর্গে বলেছেন-জগতের সকল একা মানুষকে, যারা অনেক স্বজনদের সাথে সার্বক্ষণিক জমজমাট অবস্থার মধ্যে থেকেও নিজস্বভাবে ‘খুব একাকিত্বে’ বাস করেন। একা মানুষের লিস্ট নিশ্চয়ই অনেক বড়ো। এর মধ্যে দুজনের নাম লিখে দিলাম। বাকি যাঁরা এ লিস্টে আছেন, তাঁরা বুঝে নিবেন যে,আপনাকেও এ বই উৎসর্গ করা হলো। সত্যিই তো আমরা প্রত্যেকে কত বড় একা। কবি প্রথমে আমাদের ভাবনার ক্যাম্পাসে খোঁচা মেরে দিলেন। কিছু আছে পড়ে দেখতে হয়। ৬৬কবিতার ৬০টি কাল উত্তীর্ণ বলে মনে হয়েছে। কবিতার মাঝে আছে-প্রেম,বিরহ,প্রতিবাদ আর সহজ সরল গ্রামীণ জীবন। আছে সাহসী উচ্চারণ। কবির কবিতায় পড়ে থাকে বিশাল সবুজ  ‍ভূমি,বন-বাদাড় আর বিল।


‘দ্বান্দ্বিক সময়ের কম্পিত স্বর’ গ্রন্থ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একুশে বই মেলায় প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশক: মাত্রাপ্রকাশ। প্রচ্ছদ: হৃদিতা ইসলাম শ্রেয়া। মূল্য ২২০টাকা।

গ্রামছাড়াদের কবিতায় কবি বলেছেন-
‘গ্রাম আমাদেরে টানে। গ্রামের তালগাছ টানে, বটগাছ ও গাবগাছ টানে,/
কবরস্থানের জঙ্গল টানে, এগুলোতে বসা ভূত-পেতœীরাও টানে।/
গ্রামের বাজার টানে, স্কুল টানে, তিন রাস্তার মোড় টানে,/
ডাঙুুলি খেলার গর্ত টানে, দাঁড়িয়াবান্ধার কোর্র্টে টানে/
কী হয়েছি? কবিতায় লিখেছেন-
জনপ্রিয়, শ্রদ্ধেয় হয়েছি। হয়েছি প্রেমিকও।/
এতোকিছু হবার পরে আরও অনেক কিছু হবার খায়েস আছে মনে।/
জীবন ক্যাঁচালের ফাঁকে/
আমার কেবল আজও ‘মানুষ‘ হওয়া হয়নি/
এমনকি মানুষ হওয়ার আক্ষেপও থিতু হয় না এই মনে।/
গোমতী কবিতায় বলেছেন-
গোমতীর কাদা শুষে নেয় দুই কূল/
ব্যথা নেয় কোন্ জনা?/
কান্না জলে ভাসা, নদী তলে ফাটা/
উভয় সংকটে কে না? /
চাষা, মেরুদ- ও কেউ আর বেঁচে নেই কবিতা তিনটি কথিত এলিট সমাজের গায়ে চাবুকের আঘাত।
মেরুদ- কবিতায় লিখেছেন-এদিক ওদিক সবদিকেই/
দেখছি অনেক সরীসৃপ,/
আলুর ভর্তা মেরুদণ্ডে/
ভরে যাচ্ছে এ বদ্বীপ।/
সাধক চাষা কবিতায় তিনি লিখেছেন-
চাষা বলে বকিস যাদের/
তাঁদের চাষের চাল খাস।/
মুখে খেয়ে মুখেই হাগিস/
কেমন তোরা বাদুড়জাত।/
কেউ আর বেঁচে নেই কবিতায় লিখেছেন-
কেউ আর বেঁচে নেই/
প্রতিদিন বিশ্বে কতো অন্যায় ঘটে!/
তা নিয়ে কোথাও কিছু লিখে না,/
বলে না বা করেও না।/
শুধু ঢোক গিলে আর এড়িয়ে যায়।/
আছে শুধু লতাপাতা আর/
পুতুপুতু প্রেম নিয়ে!/
এর চেয়ে বড়ো প্রমাণ আর হয়না যে/
কেউ আর বেঁচে নেই।/
পুড়ছি পাপ কবিতায় লিখেছেন-
উজান বাইতে উঠছে নাওয়ে/
আমার পেয়েছে ভাটির টান/
প্রাপ্তির বন্যায় ভাসছে সবে/
ত্যাগ-অনলে পুড়ছি পাপ।?
কোন আনচানে কবিতায় লিখেছেন-
কিষাণী যখন চিটাধান ফেলে দেয়, তার মন পোড়ে/
চা-ওয়ালা যবে পুরান চাপাতি ফেলে, তারও হৃদয় জ্বলে/
রিকশাওয়ালা যখন টায়ার পাল্টায় তারও কেমন লাগে/
রাঁধুনি যখন লাউয়ের বাকল বা চিংড়ির ছুতরা ফেলে/
তার মনেও অস্বস্তি লাগে, কেমন যেন একটু একটু পোড়ে।/
আহারে ফেলে দিলাম, আহারে ফেলে দিলাম বলে/
ভেতর থেকে হু হু করে ওঠে।/
আমারে ছেড়ে যাওয়ার সময়, তোমার কী এমন লেগেছিল?/
বুকের ভেতর জ্বলছিল? ঈরাণে ঝড় বইছিল?/
বন্দিশালা কবিতায় লিখেছেন-
মুখ খুলতে দেয় না যারা,/
সে দিবে ভাত কাপড়?/
স্বর্গের নামে নরক বেচে যারা,/
সে কোন নগরের নাগর?/
প্রবাসী কবিতায় লিখেছেন-
ভাইয়ের পড়া, বোনের বিয়ে, ঘর তোলার খরচ/
বাপ-মার ডাক্তার আর প্রতিদিনের খরচ/
সব দেওয়া চালাতে হয় মাসের পর মাস/
মোবাইল বা প্রসাধনী লাগে ঈদে আর লগ্নে/
টাকা দিলে সবার মুখে ফোটে ক্লোজআপ হাসি/
টাকা না দিলেই সবার মুখ পাতিল তলার কালি/
সবার কিছু হক আছে আমার উপর জানি/
আমার কোনো হক নাই কি তাদের উপর খানিক?/
ক্ষণিকালয় কবিতায় লিখেছেন-
ভেবেছি আমি না থাকলে সব বন্ধ হয়ে যাবে,/
কর্মযজ্ঞ, নিয়ম, প্রথা, আলো, উন্নয়ন, সব। যেতে কি পারবো ওদের ছেড়ে?/
পরে যতোবার খবর পড়েছি, দেখেছি সংবাদে/
নিজেকে খুঁজে পেয়েছি সেথায় গভীর কল্পনায়/
কিন্তু ওখানে আড়ালে আবডালে প্রকাশে আলোচনায়/
আমি কোথাও নেই, ভাবার ফুরসতও তাদের নেই।/
তুচ্ছ আমি এ জগতে তবু আস্ফালন।/
সফিকুল ইসলাম শেষ পর্যন্ত বইটি পড়তে বাধ্য করলেন। এখানেই কবির স্বার্থকতা। আশা করি পাঠকদের বইটি পড়তে ভালোই লাগবে। বইয়ের প্রসার কামনা করছি।