ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি কুমিল্লা
আমোদ ডেস্ক।।
হৈচৈ আনন্দ উল্লাস আর সবুজ নীলিমার মাখামাখি অরণ্যে ঘুরে বেড়ানোর প্রিয় ঋতু শীত। রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কাছাকাছি বা মধ্যভাগের পর্যটনের অপার সম্ভাবনার জেলা কুমিল্লা।
একটি অন্যরকম দিন কাটানোর জন্য গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের প্রাচীন জেলা কুমিল্লায় অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এক কথায় অসংখ্য প্রাকৃতিক নিদর্শনসমৃদ্ধ নয়নাভিরাম অপরূপ দৃশ্যের সমাহারে বিস্তৃত কুমিল্লায় মাত্র একদিনেই ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ ভ্রমণপিপাসু ও ঐতিহ্যপ্রেমীদের এনে দেবে পরম প্রশান্তি। কেননা অল্প সময়ে অবসর যাপনের এমন চমৎকার জনপদ পাওয়া দুষ্কর।
ধর্মসাগর পাড়
অতীত নিদর্শনের মধ্যে ধর্মসাগর দিঘি অন্যতম। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র বাদুরতলা এলাকায় ধর্মসাগর দিঘিটির অবস্থান। ত্রিপুরার অধিপতি মহারাজা প্রথম ধর্মমাণিক্য ১৪৫৮ সালে এই দিঘিটি খনন করেন। ধর্মমাণিক্যের নামানুসারে এই দিঘির নাম রাখা হয় ধর্মসাগর। এই অঞ্চলের মানুষের জলের কষ্ট নিবারণ করাই ছিল রাজার মূল উদ্দেশ্য। সাগরের মতো বড় না হলেও এটা কোনো ছোট দিঘি নয়; এর আয়তন ২৩.৮ একর। শচীন দেববর্মন আর কাজী নজরুল ইসলামের ভাবুক মনকে টানতো এই দিঘির পাড়। বাংলা সাহিত্যের কবি আল-মাহমুদও ১৯৮৪ সালে এসেছিলেন এই ধর্মসাগর পাড়ে এবং এখানে বসেই লিখেছেন, ‘এখানে সবুজ দিয়ে বুক পেতে… তুমিই বুঝি এই বাগানের চাবি।’ সাধারণত দিঘির জল স্থির ও টলটলে হয়ে থাকলেও এই দিঘিতে সবসময় খেলে একধরনের ঢেউ। শীতকালে এখানে আসে অতিথি পাখির দল। কোমল বাতাসের দোলায় মন ভরাতে এই দিঘির জুড়ি নেই।
কবি তীর্থ দৌলতপুর
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ও তাঁর স্ত্রী নার্গিসের স্মৃতি বিজড়িত স্থান কবি তীর্থ দৌলতপুর। ১৯২১ সালে নজরুল কুমিল্লার দৌলতপুরে আসেন, এখানে বসেই ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা রচনা করেন। কবি আলী আকবর খানের বোনের মেয়ে সৈয়দা নার্গিস আরা খানমকে বিয়ে করেন কবি নজরুল; যা ছিল তাঁর জীবনের প্রথম বিয়ে।
শাহসুজা মসজিদ
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী শাহসুজা মসজিদ মুঘল স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন। ১৬৫৮ সালে এ মসজিদটি নির্মিত হয়। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের ভাই শাহজাদা সুজার নাম অনুসারে এ মসজিদ নামকরণ করা হয়। কুমিল্লার মোগলটুলীতে এর অবস্থান। মসজিদটি বাইরের আয়তাকার মাপে দৈর্ঘ্য ১৭.৬৮ মিটার, প্রস্থ ৮.৫৩ মিটার। প্রাচীরগুলো ১.৭৫ মিটার পুরু। মসজিদের চারকোণে ৪টি বুরুজ এবং শীর্ষে রয়েছে ছোট গম্বুজ। প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন এ মসজিদটি দেখতে প্রতিদিনই দর্শনার্থীরা ভিড় করেন।
শালবন বিহার
শালবন বৌদ্ধবিহার বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর অন্যতম। কুমিল্লা জেলার লালমাই-ময়নামতি প্রত্নস্থলের অসংখ্য প্রাচীন স্থাপনাগুলোর একটি বৌদ্ধবিহার। এটি ১২’শ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। বিহারটির প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ এবং চার দিকের দেয়াল ৫ মিটার পুরু। বিহারে সর্বমোট ১৫৫টি কক্ষ আছে। এই কক্ষগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন এবং বিদ্যাশিক্ষা ও ধর্মচর্চা করতেন। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিহারটির ধ্বংসাবশেষ থেকে ৮টি তাম্রলিপি, প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটা, সিলমোহর, মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে।
ময়নামতি জাদুঘর
১৯৬৫ সালে কুমিল্লা কোটবাড়ির শালবন বিহারের দক্ষিণপাশে একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়। জাদুঘর ভবনে মোট ৪২টি আধার রয়েছে। আধারগুলোতে প্রদর্শিত হচ্ছে বিভিন্ন মূর্তি, টেরাকোটা, স্বর্ণ, রৌপ্যের মুদ্রাসহ বেশ কিছু পাথর। রয়েছে তুলট কাগজে লেখা প্রাচীন হস্তলিপির পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন মৃৎপাত্র।
ইটাখোলা মুড়া
কুমিল্লা জেলার ময়নামতি অঞ্চলে অবস্থিত এটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সৌধস্থল। এই প্রত্নস্থান পাহাড়ের গায়ে ৩টি স্তর বিদ্যমান। প্রাচীনকাল থেকেই এই স্থানটি ইট পোড়ানোর খনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এজন্যই এর এমন নামকরণ করা হয়েছে।
রূপবান মুড়া
এটিও ময়নামতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। কালীরবাজার সড়কের দক্ষিণে একটি টিলার উপর এই মুড়া অবস্থিত। গভীর খননকার্যের ফলে দেখা যায় যে, এর নিমার্ণ, সংস্কার ও পুনঃনিমার্ণের ৩টি স্তর রয়েছে। খননকার্যের পর ক্রশাকৃতি একটি আকর্ষণীয় সমাধি মন্দির, অষ্টাকোণাকৃতি স্তুপসহ বর্গাকৃতির কিছু স্তুপ পাওয়া গেছে।
জগন্নাথ মন্দির
এটি সতেরো রত্ন মন্দির নামেও পরিচিত। টেরাকোটা মন্দিরটির ইটভাটা মন্দিরের স্থাপত্যের সাধারণ শৈলী। মন্দিরটির ১ম তলায় ৮টি, ২য় তলায় ৮টি এবং কেন্দ্রে আরও ১টি রত্ম নিয়ে মোট ১৭টি রত্ন ছিল। মহারাজা ২য় রত্নমাণিক্যর নিমার্ণ কাজ শুরু করলেও শেষ করেন মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য।
বার্ড
বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৯ সালের ২৭ মে তৎকালীন সরকার এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরিচালক হিসেবে নেতৃত্ব দেন ড. আখতার হামিদ খান। মোট ১৫৭ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত বার্ড ক্যাম্পাসে রয়েছে ৫টি হোস্টেল, ৪টি কনফারেন্স কক্ষ, ২টি ক্যাফেটেরিয়া, ১টি মসজিদ, ১টি গ্রন্থাগার ও ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটি কুমিল্লা শহর থেকে ১০ কি.মি. পশ্চিমে কোটবাড়িতে অবস্থিত।
ময়নামতি ওয়ারসিমেট্রি
এটি কুমিল্লায় অবস্থিত একটি কমনওয়েলথ যুদ্ধসমাধি। ১৯৪১-৪৫ সালের ২য় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৭৩৭ জন সৈনিকের সমাধি ক্ষেত্র এই ময়নামতি। এখানে রয়েছে সবুজ বনানী আর ফলে-ফুলে ভরা বাগান ও বিশালাকার স্তম্ভ।
গোমতী নদী
গোমতী নদীটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৯৫ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৬৫ কিলোমিটার এবং নদীর প্রকৃতি সর্পিলাকার। এ নদীটি তীব্র খরস্রোতা। এটি কুমিল্লা জেলার আদর্শসদর উপজেলার কটকাবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস ও দাউদকান্দি উপজেলা হয়ে মেঘনা নদীতে পতিত হয়েছে।
রাণীর কুঠি
রাণীর কুঠি কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঐতিহ্যবাহী ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে ছোটরা মৌজায় অবস্থিত। এটি তদানিন্তন মহারাজা মাণিক্য কিশোর বাহাদুরের স্ত্রীর বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করতেন। পুরনো এই বাড়িটি আজও কুমিল্লার ঐতিহ্য বহন করে আসছে।
বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্র
এটি বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র। এটি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলায় অবস্থিত। ১৯৬৯ সালে তদানিন্তন পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি এটি আবিষ্কার করে।
নবাব ফয়জুন্নেসার জমিদার বাড়ি
এটি কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁও এলাকায় অবস্থিত এক ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। এই বাড়িটি ডাকাতিয়া নদীর তীরে অবস্থিত। বাড়িটিতে একটি প্রবেশদ্বার, বসবাসের দ্বিতল বিশিষ্ট ভবন, একটি কাছারিঘর, বাগানবাড়ি, মসজিদ ও কবরস্থান রয়েছে।
এছাড়াও কুমিল্লা শহরের মধ্যস্থলে আছে বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও মিলনায়তন, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথদত্ত স্টেডিয়াম, পাঁচ পীরের মাজার, চান্দিমুড়া মন্দির, সংগীতজ্ঞ শচীনদেব বমর্ণের বাড়ি, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি, জোড় কানন দিঘি, রাজেশ্বরী কালীমন্দির, নজরুল ইনস্টিটিউট, জগন্নাথদিঘি। এসব দর্শনীয় স্থানগুলো যুগ যুগ ধরে কুমিল্লার ঐতিহ্যকে বহন করে আসছে।