ইফতারে মুরাদনগরের মাশকলাইয়ের আমিত্তি

মমিনুল ইসলাম মোল্লা,মুরাদনগর।।
বর্তমানে চলমান ফাস্টফুড কালচার এবং তারকা হোটেলের বুফে আয়োজনও মুরাদনগরের ইফতারের জনপ্রিয়তায় চিড় ধরাতে পারেনি। বহু বছরের পুরোনো এই ইফতার বাজার যেমন ঐতিহ্যবাহী, তেমনি আশে পাশের উপজেলাগুলোতেও রয়েছে এর সুখ্যাতি। বিশেষ করে মাশকলাই ডালের আমিত্তি রোজাদারদের নজর কাড়ে। বি এন উইকপিডিয়ার তথ্য মতে, চট্টগ্রাম বিভাগের সবচেয়ে বড় উপজেলা মুরাদনগরের উত্তরে নবীনগর, দক্ষিণে চান্দিনা ও দেবিদ্বার, পূর্বে দেবিদ্বার, ব্রাহ্মণপাড়া ও কসবা এবং পশ্চিমে দাউদকান্দি, তিতাস, হোমনা, ও বাঞ্ছারামপুর অবস্থিত। এ উপজেলাগুলোতেও মুরাদনগরের আমিত্তির কদর রয়েছে। বিশেষ করে শবে বরাত, শবে কদর, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার মিলাদ মাহফিলে মুরাদনগরের আমিত্তি না হলে যেন রসনা অতৃপ্ত থাকে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ” বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি –কুমিল্লা” নামক পুস্তকেও মুরাদনগরের মাশকলাইয়ের আমিত্তি, রামচন্দ্রপুরের লেডি কেনি মিষ্টির সুখ্যতির কথা বলা হয়েছে। রমজানের পুরো মাসই মুরাদনগরের অলিতে-গলিতে আমিত্তি কিনতে দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায় মানুষকে। বলতে গেলে, প্রথম দিন থেকেই জমে উঠে ঐতিহ্যবাহী জিলাপির বাজার। সরেজমিনে বিকেলে মুরাদনগর এলাকার ইফতার বাজারে গেলে দেখা যায় চিরচেনা হৈহুল্লোড়-হৈ-চৈয়ের চিত্র। এছাড়া কোম্পানীগঞ্জ বাজারের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে বিশেষ করে বিকেল বেলা অস্থায়ী ইফতারি সামগ্রী বিক্রির দোকানগুলোতেও বিশেষ দামে বিক্রি হচ্ছে এই জিলাপি।
জিলাপির সর্বাধিক পুরনো লিখিত বর্ণনা পাওয়া যায় মুহম্মদ বিন হাসান আল-বোগদাদীর লিখিত ১৩শ শতাব্দীর রান্নার বইতে, যদিও মিসরের ইহুদিরা এর আগেই খাবারটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিল। ‘বড় বাপের পোলায় খায় ঠোঙায় ভইরা লইয়া যায়’, ‘আসেন আসেন’, ‘বাইছা লন ভালো খান’ ‘লইবেন একবার খাইবেন বারবার’সহ নানা হাঁক-ডাক শোনা যায়। মুরাদনগর বাজারে একদিকে চলছে ইফতার তৈরি, অন্যদিকে সাজানো। কেউ আবার ব্যস্ত বিক্রিতে। ক্রেতারাও কিনছেন যার যার পছন্দ আর সামর্থ অনুযায়ী। বিক্রেতারা জানান, এখানে পাকিস্তন আমল থেকে এই আইটেম চলে আসছে। আমাদের খাবার তৈরির খরচ বাড়লেও দাম সেই তুলনাই বাড়াইনি, লাভের পরিমাণটা কমিয়ে দিয়েছি।
আলুর চপ বা বেগুনির ভিড়ে মুড়ি মাখানো ইফতারের টেবিলে কিছুটা নীরবেই থাকে। তবে এটাই হলো ইফতারের সবচেয়ে সেরা খাবার। একটি বড় পাত্রের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের খাবারের সঙ্গে মুড়ি মিলে তৈরি করা হয় মুড়ি মাখা। আর এই মুড়ি মাখায় মুরাদনগরের মাশকলাইয়ের জিলাপি মেশানো হবে কি না তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায় ডাইনিং টেবিল থেকে ফেসবুকের কমেন্ট সেকশন অবধি।
জিলাপি প্রেমিকদের মতে মুড়ি মাখা আমিত্তি নোনতা-মিষ্টির সংমিশ্রণ স্বাদে সেরা । কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী শাহীনের জিলাপি আসক্তি রীতিমতো উদ্বেগজনক পর্যায়ের। মুড়ি মাখার সঙ্গে জিলাপির সংমিশ্রণের প্রসঙ্গ আসতেই তিনি বললেন, ‘অনেক মানুষ আইসক্রিমে ডুবিয়ে ফ্রেঞ্চফ্রাই খায়। তাহলে আমি কেন মুড়িতে আমিত্তি মেশাতে পারব না? এটাকে বলে স্বাদের নতুনত্ব। কথা হয় হোম মেকার মা মুক্তার সঙ্গে। যিনি বাড়িতে রীতিমতো টেবিলভর্তি ইফতারের আয়োজন করেন। তিনিও মুড়ি মাখার সঙ্গে আমিত্তি মিশ্রণের পক্ষের মানুষ।প্রসঙ্গ উঠতেই একটু যেন ক্ষেপেই গেলেন মুক্তা।তিনি বলেন, ‘আমি রান্নাঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে ইফতার তৈরি করি। এখন আপনি বলছেন আমিত্তি আলাদা পরিবেশন করতে হবে? না ধন্যবাদ, আমিত্তি মুড়ির সঙ্গেই মাখানো হবে।
মুরাদনগর সদরের আল্লাহু চত্তরের দক্ষিণ দিকে গিয়ে পশ্চিম পাশেই তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী আমিত্তি। বেশ কয়েকটি দোকান এ খাদ্য তৈরির সাথে জড়িত। কেজি আমিত্তি ২২০ টাকা। কারিগররা বলেন, মাসের আমিত্তি তৈরি করার জন্য প্রথমে যা করা হয় তা হলো মাসের বা মাসকলাইয়ের ডালগুলোকে ভাল ভাবে ধুয়ে নেওয়ার পর পরিষ্কার জলে সারারাত ভিজিয়ে রাখা হয়। ভিজিয়ে রাখার ফলে ডাল থেকে কালো পাতলা চামড়া আলগা হয়ে আসে। ডালগুলোকে তারপর অত্যন্ত মিহি করে বাটা। বড় একটি কড়াইয়ে বাটা ডালের পেস্ট রেখে ভালভাবে ফোটাতে হয় ফলে ডাল অত্যন্ত মসৃণ ও মিহি হয়। তারপর এর সাথে খাবার বার্লি সামান্য পরিমাণ মিশানো হয়। মেশানো হয়ে গেলে এই পেস্টটাকে আমিত্তি তৈরির কাপড়ের নাতনিতে ঢেলে, বড় কড়াইয়ে গরম তেলে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খাস্তা আমিত্তি তৈরি করা হয়ে থাকে। তারপর এই খাড়া আমিত্তিগুলোকে চিনির শিরায় ভালোভাবে ভেজানো হয়। ভেজানো আমিত্তিগুলোকে শিরা থেকে ছেকে তুলে এনে পরিবেশন করা হয়।

inside post
আরো পড়ুন