ইরান যুদ্ধ করেনি, ইতিহাস রচনা করেছে


মনোয়ার হোসেন রতন।।
ইতিহাস কিছু মানুষকে শুধু স্মরণ করে না, চেতনায় ধরে রাখে। ২০২৫ সালের জুনের আগুনঝরা দিনগুলোতে, যখন মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ কাঁপছে বিস্ফোরণে, তখন একক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ইরান শুধুই যুদ্ধ করেনি, তারা লিখেছে এক নতুন অধ্যায়—বীরত্ব, আত্মমর্যাদা ও আত্মত্যাগের অনন্ত গাথা।
ইসরায়েলের “অপারেশন মিডনাইট হ্যামার” আঘাত হানে ইরানের পরমাণু কেন্দ্র, হাসপাতাল ও বিদ্যুৎ অবকাঠামোয়।
তারা ভেবেছিল, ইরান চুপ থাকবে, অথবা কূটনীতির পাতায় হার মানবে। কিন্তু ইরান প্রতিরোধ করে—রক্ত দিয়ে, আগুন দিয়ে, ঐতিহ্য দিয়ে।
যুদ্ধ যখন শুরু হয়, ইতিহাস তখন চোখ মেলে চায়, ইরানের জবাব আসে নিছক ‘
প্রতিশোধ’ নয়—এ ছিল জাতিসত্তার সম্মান রক্ষার লড়াই। হাইফা, তেলআবিবের সামরিক ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র বৃষ্টির মতো নামে। বিশ্ব চমকে ওঠে—কে বলেছিল, ইরান দুর্বল? কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়।
ইরান শুধু ইসরায়েলকে নয়—মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতেও আঘাত হানে বীরের মতো। ইরাকের আল-আসাদ ও এরবিল ঘাঁটিতে আঘাত হানে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র। সিরিয়ায় মার্কিন লজিস্টিক সেন্টার গুঁড়িয়ে দেয়। কুয়েতের ঘাঁটিতে সরাসরি হামলার হুমকি দেয় এবং কৌশলে সামরিক সরঞ্জামের চলাচল বন্ধ করে দেয়।
বাহরাইনের ৫ম নৌবহর, যেখান থেকে ইসরায়েলকে সাহায্য পাঠানো হয়েছিল—তার চতুর্দিকে ছায়ার মতো ঘুরেছে ইরানি ড্রোন। এ সব আঘাত ছিল নিখুঁত, সাবলীল—আর ছিল সাহসের শেষ উচ্চারণ।
ইরানের কণ্ঠ ছিল গোলা-বারুদের চেয়ে বেশি ওজনদার তারা বলেনি—”আমরা পরাশক্তি”, তারা বলেনি—”আমাদের আছে পরমাণু অস্ত্র”, তারা বলেছে—“আমরা সেই জাতি, যারা কারবালার চেতনাকে রক্তে ধারণ করে। যারা জানে কীভাবে মরতে হয়, আবার জানে কবে মাথা উঁচু করতে হয়।”
এ আঘাত শুধু সামরিক কৌশল ছিল না—এ ছিল বিশ্ব শক্তির মানচিত্রে কাঁপন তোলা এক বার্তা:“আমরা গোলাম নই। আমরা অস্তিত্ব।”
কেন এই বিজয় ছিল ঐতিহাসিক? কারণ ইরান জানত—তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের সেরা সামরিক ও প্রযুক্তি শক্তির জোট। তবু তারা এগিয়েছে, জানার পরও।
তারা জানত, এই যুদ্ধের অর্থ—রক্ত, ধ্বংস, অবরোধ। তবু তারা সরে দাঁড়ায়নি। তারা বলেছে—“আমরা পরাজয় স্বীকার করবো না, কারণ পরাজয় মানে আমাদের আগামী প্রজন্মের গলার শিকল। আর আমরা চাই—তারা যেন জন্ম নেয় মাথা উঁচু করে, চিতকার করে, বীরের মতো।”
বিশ্ব কূটনীতি আর গণমাধ্যমের‘নীরবতা’ ছিল আরেক যুদ্ধ: ইরানের প্রতিরোধ দেখেও অধিকাংশ মুসলিম দেশ মুখ খোলেনি।
বেশিরভাগ রাষ্ট্র কেবল বিবৃতি পাঠিয়েছে, “উভয়পক্ষকে সংযত হতে আহ্বান” জানিয়ে। এমনকি যুদ্ধবিরতির পরও কেউ বলেনি—”ইরান আত্মরক্ষা করেছে।” কিন্তু ইতিহাস এমন নয়। ইতিহাস দেখে কে প্রথম আঘাত করেছে, আর কে শেষ পর্যন্ত মাথা নোয়ায়নি।
ইরান শুধু যুদ্ধ করেনি, আত্মমর্যাদার মানচিত্র রচনা করেছে: ইরানের প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র, প্রতিটি ড্রোন, প্রতিটি শহীদের রক্ত, শুধু ধ্বংস করেনি—তারা একটি প্রশ্ন রেখে গেছে এ বিশ্বসভ্যতার দ্বারে:“শান্তি মানে কি শুধু শক্তিশালীর বিজয়? আর স্বাধীনতা মানে কি শুধু আনুগত্য?”
এ প্রশ্নের মুখোমুখি আজ সবাই। শেষ দৃশ্যপট: ইরান যখন দাঁড়িয়ে থাকে, বাকি সবাই বসে পড়ে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, কিন্তু ইরান মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়ায় ধ্বংসের মধ্যেও। তাদের নেতারা বলেননি “আমরা জিতেছি”, তারা বলেছেন—
“আমরা মাথা নোয়াইনি, এতেই বিজয়।”
এ লড়াই তাদের অস্ত্রের নয়, ছিল চেতনার।
তারা যে বার্তা দিয়ে গেছে—তা যুগ যুগ ধরে প্রতিধ্বনিত হবে প্রতিটি নির্যাতিত জাতির কণ্ঠে। তারা দেখিয়ে গেছে—একটি জাতি কেবল তখনই অজেয় হয়, যখন তার অস্ত্র হয় আত্মত্যাগ, তার ভাষা হয় আত্মমর্যাদা।
ইতিহাসের শেষ পঙক্তি তাই এভাবেই লেখা হোক: “যে জাতি ভীত না হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, সে জাতির পক্ষে পরাজয় সম্ভব নয়। ইরান সেই জাতি—যাদের অস্ত্র নয়, আত্মা লড়াই করে। তারা যুদ্ধ করেনি, তারা ইতিহাসের পৃষ্ঠা রচনা করেছে রক্ত দিয়ে লিখে।”